Saturday, June 7, 2025

ইওরোপে কটাদিন(ভিয়েনা পর্ব ২)

শনব্রুন প্যালেস অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত জায়গা। মানে সত্যি বলতে এটা ভালো করে দেখতেই পুরো দিন চলে যেতে পারে। মনে আছে সেই এম্ব্যাসি থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, কী দেখতে চাও অস্ট্রিয়ার? তা সে সময় আমার ভিয়েনায় শনব্রুন ছাড়া আর কিছু মনে পড়েনি। কে জানে তাতেই কনভিন্স হয়েছিল কিনা! যাকগে, তো শনব্রুন হল, ওই হাবসবুর্গারদের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান। জন্মালে রাজা হওয়াই ভাল মশাই। রাজাদের যুদ্ধ করতে হয়না, যুদ্ধ করে সেনাপতির ইন্সট্রাকশনে সৈনিকরা, কূটনৈতিক বুদ্ধি দেয় মন্ত্রীরা, টাকা দেয় প্রজারা। রাজার কাজ আরাম করা। শনব্রুন বিখ্যাত জায়গা, সকাল থেকেই লোক প্রচুর। তবে জায়গাটা এতই বিরাট অসুবিধে হয়না। মিউজিয়াম দেখার সময় নেই, মামে যে পরিমান টিকিটের টাকা সেটা দিয়ে একঘন্টা মিউজিয়াম দেখে চলে আসার মানেই নেই। এমনিই আমাদের মিউজিয়াম দেখতে সময় লাগে।  তা আশপাশ দেখবো, যদিও বিরাট এক্সপেক্টেশন ছিল না। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে দেখি, ওরে বাবা এ তো বিরাট বাগান হে! রাজা রানীদের পায়ের জোর ছিল বলতে হবে! বাগান মানে সাজানো ছোট ছোট গাছের বাগান না। বিরাট এলাকা নিয়ে, বড় বড় গাছ, সেই গাছগুলকেই ছেঁটে গাছেদের প্রাচীর করেছে কোনো কোনো জায়গায়। যেমন বেড়া দিতে দেখি না? ওরকমই খালি এক্ষেত্রে বৃক্ষ। ঘাসে ঘাসে বসন্তের আগমনী, হলুদ, সাদা ফুল। যতই হাঁটি যতই ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়ি করে বড়লোক ট্যুরিস্ট চলে যাচ্ছে। ঘোড়াগুলো ভারী চকচকে এখানে।  হাঁটতে একটা পাহাড়ের ঢাল এলো। ট্রেইল আছে, ঘাসের মাঝ দিয়ে। আধখানা রাস্তা উঠলে বসার বেঞ্চ আছে। ওখান থেকেই শনব্রুন সহ ভিয়েনা শহর দেখা যায়। মোলায়েম রোদ, শান্ত পরিবেশ, চুপ করে বসে ছিলাম অনেক্ষণ। অনেক অনেক দিন অব্দি এক বেঞ্চে বসে টিফিন বক্স থেকে বের করে পুরভরা বেকড পাঁউরুটি খেতে খেতে চারপাশ দেখার আনন্দটা মনে থাকবে। কী জানি কেন,  আমাদের দেখে হয়তো মানুষজনের মায়া হয়, নিজে থেকেই এসে অনেকে বলে ছবি তুলে দেব তোমাদের? এবারের পুরো বেড়ানো জুড়েই তাই হয়েছে। এত অযাচিত ভালোবাসাও মনে থাকবে বহুদিন। 


ওখান থেকে চললুম বেলভেডেয়ার প্যালেস। সাজানো গোছানো প্যালেস যেমন হয়। ভারী সুন্দর কম্বিনেশনে ফুলগাছ বসিয়েছে। এক ভদ্রলোককে দেখলাম চুপ করে একটা গাছের নীচে বসে আছেন। আরেকজন বই পড়ছেন। দুজন মানুষ চুপচাপ পাশাপাশি বসে। কেউই ফোন ঘাঁটছেনা। দেশে ফিরে আমাকেও মোবাইল ব্যবহার কমাতে হবে।

 hundertwasserhaus বলে একখান বাড়ি আছে এখানে। hundertwasser নামে এক আর্কিটেকচার তৈরী করেছিল বাড়িখানা। বাড়িটায় দুশোটার বেশী গাছ আছে, ছাদে আর ব্যালকনিতে মিলিয়ে। গাছেদের ভাড়াটে হয়ে মানুষ আছে বলা যায়। বাড়িটার স্ট্রাকচারটাও অন্যরকম। এই hundertwasser  ভদ্রলোক একজন আর্টিস্ট ছিলেন, তারপর হলেন আর্কিটেকচার। ফলে অন্যরকম একটা বাড়ি তৈরী হল। তা ইওরোপ তো বানিজ্য ভালোই পারে, ফলে উল্টোদিকেই এই ভদ্রলোকের কাজের ছোট ছোট মিমিক আর্ট বানিয়ে বিক্রিবাটা করার দোকানপাট করেছে বেশ।  দোকানগুলো,ট্র‍্যাডিশনাল দোকানের মতো না করে খানিক কায়দা মতো করে সাজানো, ইন্টেরিয়রও তাই। ফলে পুরোটা ঘুরতে মন্দ লাগেনা। কিছু কেনাকাটার প্রশ্নই নেই যদিও! 


আমাদের পকেটের জোরের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তাও কী খেয়াল হল এখানকার বিখ্যাত ক্যাফে সেন্ট্রালে অ্যাপেল স্ট্রুডেল খেতে যাই চল। তখনো খাইনি জিনিসটা। তা চলো একবার দেখাই যাক বলে যাওয়া গেল। ইওরোপের গলি যেমন হয়, কব্ ল স্টোন রোড বলে যাকে আর কি। এরা একই রকম পুরোনো ভাবটা বজায় রাখায় সেই বিকেলে মনে হয় যেন এক্ষুনি খটাখটা করে কোনো সৈনিক এসে হাজির হবে,  কিংবা কোনো ঘোড়সওয়ার।  ভাবতে ভাবতেই, দেখি একটা ঘোড়ার গাড়ি খটরমটর করতে করতে করতে আসছে। আগেই বলেছি ব্যবসা ভালোই বোঝে এরা। আর সৌন্দর্য বোধটা আছে বলে সেই ঘোড়ার গাড়ির সাথে একটা ট্রে মতো জুড়ে দিয়েছে ঘোড়ার পিছনেই যাতে করে ঘোড়া মলত্যাগ করলে রাস্তায় নোংরা করতে করতে যাবে না, ওই ট্রেতেই কালেক্ট হয়ে যাবে। ক্যাফে সেন্ট্রালে লাইন পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে খুবই বিখ্যাত। আমাদের এসব জায়গা যাওয়ার কথা না, তাও ওই আর কি। লাইন দিয়ে ঢুকলাম৷টেবিলে বসে মেনু কার্ড দেখলাম।ধরুন  মেঘলা দিন, বেশ ভালো করে খিচুড়ি ঘি, বেগুনি ডিমভাজা দিয়ে খেয়ে একটু চোখ লেগে গেছে, স্বপ্ন দেখছেন, পাহাড়ি রাস্তায় একটা পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটছেন। সেসময় টিমস কল এলো, যেরকম ধড়মড় করে  চোখ, নাল টাল মুছে যেভাবে বাস্তবে ফেরেন ওরকমই হল মেনু কার্ড দেখে। অগত্যা কী আর করা। অগনিত বার, কলেজ পড়ার সময় যেমন মেনু কার্ড দেখে চুপচাপ চলে আসতাম, সে জিনিসেরই রিপিট টেলিকাস্ট করতে হল। 



একটা সময় ছিল যখন দানিয়ূব এতই চওড়া হয়ে গিয়েছিল, পলিতে পলিতে ভারক্লান্ত হয়ে দুকূল ছাপাতো। ভিয়েনা প্লাবিত হত। তা প্রথম বিশ্বের সরকার নিজেদের দেশের প্রতি খুবই লয়্যাল। ওরা চুরি ডাকাতি যাইই করে সব তৃতীয় বিশ্ব থেকে। ফ্রান্স আজও আফ্রিকার দেশ গুলো থেকে ট্যাক্স আদায় করে, কারণ আফ্রিকার দেশগুলো নিজেদের টাকায়, নিজেদের রিসোর্স দিয়ে নিজেদের দেশে রাস্তা, ব্রিজ ইত্যাদি বানিয়েছিল। অবশ্য ফ্রান্স সেসময় নিজের ইচ্ছেয় গিয়ে ওদের থেকে জিনিসপত্র লুন্ঠন থুড়ি এমনিই না জোর করে নিয়ে আসছিল। তাই আজও ট্যাক্স নেয়। বা এই যে এত অস্ত্র তৈরী করে প্রথম বিশ্বের দেশ, তৃতীয় বিশ্ব একটু নিজেদের মধ্যে না লড়লে বেচারার কাকে বিক্রি করবে সেসব? আমাদের দেশের নেতারা অবশ্য নিজেদের লোকেদের ছিবড়ে করেই মোক্ষ লাভ করে। যাই হোক, যা বলছিলাম, এদের সরকার বাঁধ দিয়ে খাল খেটে, একটা বিরাট দ্বীপ বানিয়ে নেয় এইখানে যাতে করে বন্যা থেকে বাঁচা যায়। সে দ্বীপ সবুজে সবুজ। লোকে দৌড়চ্ছে, হাঁটছে, মাছ ধরছে। আমরাও গেলাম।ঘড়ির কাঁটায় ছটা পার হয়ে গেছে এদিকে আকাশ দেখলে মনে হবে এখনো বিকেল।আকাশ পরিষ্কার নীল, সেই নীলে দানিয়ূবও ঘন নীল। আচ্ছা দানিয়ূব নদ না নদী? দানিয়ূব নামটা অবশ্য মহিলা নাম নয় ঠিক।।  রোদ মেখে মেখে হেঁটে বেড়ালাম, দানিয়ুবের জলে হাত ডোবালাম। এদেশে জলের জন্যে রাস্তায় রাস্তায় কল আছে, একটু খুঁজে নিতে হয়। তবে আমাদের মতো যে কোনো জায়গায় যে কেউ চাইলেই জল দেবে এমন না। তবে যেহেতু কলের জল খাওয়া যায়, তাই লোকে টয়লেট থেকেও জল ভরে নেয়। আমার একটু ইয়ে আছে বলে সেটা পারিনি। অনেক জায়গাতেই পুরানো দিনের হাত দিয়ে ঘোরানো টিউবওয়েল আছে। এই দ্বীপেও ছিল একটা,  একটু অন্য রকম আমাদের দেশের মতো না, একবার হ্যান্ডেল ঘোরাও করো তারপর জল খাও। একটা ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছি, একটা আইসক্রিম ওয়ালা ঠেলা নিয়ে গেল। কোয়ালিটি ওয়ালস এর মতো লোগো। নদীর ধারে পাব আছে, কয়েকজন পুরুষ নারী বসে বসে বিকেলের আলোয় পানীয় নিয়ে গল্প করছে। সাইক্লিং করছে অনেকে। সব মিলিয়ে বড় মনোরম চারপাশ, ঘড়ি কাঁটা কখন ঘুরে যায় টের পাওয়া যায় না, ছবি তোলা ছাড়া ফোন দেখতেও ইচ্ছে করে না। 


অনেকক্ষণ কিছু খাইনি খেয়াল আছে? মৌসুমী সুদীপের অফিস শেষ, আজ আমাদের সান্ধ্যপিকনিক।  হাঁসভাজা, আর কী কী সব ভালো ভালো খাবার নিয়ে পার্কে বসা গেল। হেঁটে হেঁটে পা প্রায় খুলে এসেছে তখন। সুদীপটার পায়ে নির্ঘাত চ্যাটজিপিটির মডেল লাগানো আছে, চ্যাটজিপিটির যেরকম যতই প্রশ্ন হোক বিরক্ত হয়না, সুদীপও যতই হাঁটা হোক ক্লান্ত হয়না। সন্ধ্যের আবছা আলোয়, অতি সামান্য আয়োজনে আমাদের চারজনের ফূর্তি দেখে কে! একটু দূরে আরেকটা জায়গা আছে। হালুয়া আইস্ক্রীম পাওয়া যায়। এক দফা খেয়ে আমরা চললুম, সে জিনিস খেতে। জিনিসটার হদিশ সুদীপই দিয়েছে। ছোট্ট টার্কিশ দোকান। বেশ খেতে জিনিসটা। পেস্তার ফ্লেভার হালুয়া আইস্ক্রীম।  অন্ধকার ফাঁকা বিদেশী অচেনা শহরে বন্ধুদের সাথে বসে থাকার এই সন্ধ্যেটাও মনে থাকবে বহুদিন। ও হ্যাঁ টার্কিশ নারীদের দেখতে বেশ হয় কিন্তু। 
হাবাদ্বয় আমরা আর সুদীপ -মৌসুমী


না  এফেন্দি আমরা হালুয়া খাব


আইসস্ক্রীম হালুয়া


রাত নামে ক্রমে। আমাদের এনার্জিটা দেখেছেন একবার!! বাপরে বাপ! সেই সকালে শনব্রুণ প্যালেসে বাগানে এন্তার হাঁটাহাঁটি দিয়ে শুরু হওয়া দিন হালুয়া খেয়েও থামেনি।আমরা চললুম রাতের ভিয়েনা দেখতে। সুদীপ বলেছিল, 'ভিয়েনার নাইট লাইফ বলে কিছু নেই, এরা দিন শুরু করে তাড়াতাড়ি আর রাত নামলেই ঘুমিয়ে পড়ে।' কিন্তু আমি ঠিক পার্টি অ্যানিমাল নই, মোচ্ছব করতে যাচ্ছি তাও না। স্রেফ দেখবো, একটা শহর রাতে কেমন হয়। ওই যে অত বড় বড় স্থাপত্য,  হলুদ আলোয়, পার্কের ছায়ার কেমন লাগে।রাতের ভিয়েনা সত্যিই নিষ্প্রাণ, অবশ্য একটা দুটো লোক এই রাতেও ছুটে চলেছে দেখছি! দু চারটে রেস্তোরাঁয় লোকজন বসে আছে খাবার পানীয় নিয়ে। সত্যি বলতে যে কোনো জায়গাই মানুষ থাকলে একরকম,  না থাকলেই কেমন আবছা মতো অচেনা মতো হয়ে যায়। সবাই যেন নি:সাড়ে অপেক্ষা করে কতক্ষণে আমরা চলে যাব, নিজেদের মধ্যে ফের গল্প আড্ডা মারবে। "জানিস আজ একজন বুড়ি একা একা ঘুরছিল, স্প্যানিশে কথা বলছিল।" " উফফ আজ চীনাদের দলটা কিছু বড় ছিল"! "আজ রোদ্দুরে লোক খুব হয়েছে, একটা দিন  গেল বটে"। "হ্যাঁ রে ওই যে বোঁচকা বেঁধে দুটো ছেলে মেয়ে এসেছিল, ওরা কি হোমলেস? অত বড় ব্যাগ নিয়ে ঘোরে কেন? দেখ দেখ আবার এসেছে, চুপ চুপ"।  

রাতের ভিয়েনা

ওদের প্রাইভেসীতে আর ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চলে আসি গুটি গুটি। কাল সক্কালেই উঠে যাওয়া আছে। আল্পসের কোলে...

2 comments:

  1. বাহ। আবার ফিরে গেলুম যেন। টাকা জমাই চলো। আবার মাস খানেকের জন্য যাব

    ReplyDelete
  2. বাহ বাহ, আরো লেখ। পরের পার্ট।

    ReplyDelete