Monday, August 5, 2024

হাইল্যান্ডে (স্কটল্যান্ড প্রথম পর্ব)

লন্ডনে ঘোরার গল্প মুলতুবি রেখে স্কটল্যান্ড ঘোরার গল্প হোক বরং। হ্যাঁ বিস্তর দেরী করছি গল্প শোনাতে। হয়তো আগের গল্পের খেই হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। মানে আদৌ যদি পড়ে আর কি। যাইহোক, আমাদের রেস্তোঁ কম, অল্প সময়ে সব দেখাও যাবে না।  লন্ডন ঘুরেই চলে আসবো তা হবে না। ইংলিশ চ্যানেল পার করলেই ফ্রান্স দেখে আসা যায় কিন্তু শেঞ্জেন ভিসা লাগবে আবার। তাছাড়া শুধু ফ্রান্স দেখে চলে আসলে কীভাবে হবে! তাহলে আরাম করে স্কটল্যান্ডটাই হোক। ইউকেতেই থাকা যাক। 

স্কটল্যান্ড যাবার অনেক উপায় আছে তার মধ্যে সব চেয়ে সস্তা হল বাস। সময় নেয় অনেকটা। প্রায় দশ ঘন্টা মতো। কিন্তু দিব্যি দেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। সত্যি বলতে কি, সকাল বাস ছেড়েছিল কিন্তু আমরা একটুও বোর হইনি সারাটা রাস্তায়। দোতলা বাস। বাসের সামনের সিটগুলো বুক করে রেখেছিলাম আমরা। উঁচু থেকে সবটা দেখতে পাওয়া যায় চমৎকার।  মাঝে কয়েকটা হল্ট দেয়। সাত সকালে সেই হাউন্সলো থেকে ট্রেনে চড়ে লন্ডনে এসে পৌঁছে ভিক্টোরিয়া কোচস্টেশনে এসে পৌঁছনো গেল। এখান থেকেই স্টোনহেঞ্জ যাবার বাস ছেড়েছিল বটে কিন্তু সেটা এক্স্যাক্টলি ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের এদিক থেকে না।  স্টেশন কথাটা কেত মেরে বলছি না, এমনিতেও নামটা তাই আর তাছাড়া বাস ডিপো বললে ব্যপারটা আমাদের ধর্মতলা কি হাওড়া কি শিলিগুড়ি এসব মনে হতে পারে। সে এয়ারপোর্টের মতো ব্যপার প্রায়। সিকিউরিটির ঝামেলা বাদে। বড় বড় স্ক্রীন টাঙানো আছে, লন্ডন থেকে নানান জায়গায় বাস যায়। সমস্ত দূরপাল্লার বাসের ছাড়ার সময় পৌঁছবার সময়,  সব দেওয়া আছে। প্রতিটা বাসের নির্দিষ্ট গেট আছে, সেখান থেকেই তারা ছাড়বে বা সেখানে এসেই থামবে। গেট গুলো আমাদের এয়ারপোর্টের একতলা যেমন ওরকমই। অটোমেটিক কাচের দরজা খুলে বাইরে যেতে পারো কিন্তু ফের ভিতরেই আসতে হবে কারণ সময়ের আগে সেখানটায় অন্য কোনো বাস বা প্যাসেঞ্জারের ভীড় নেই বা ফাঁকা। এদের এখানে লকার রেন্ট পাওয়া যায়। চাইলে কেউ মালপত্র এখানে রেখে সারাদিন ঘুরে নিতে পারে। বাস এলো, বাসের পেটে মালপত্র পুরে নাম মিলিয়ে উঠে জায়গায় বসাও হল।

লন্ডন শহর পেরোতেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যায়। স্টোনহেঞ্জ যাবার সময়ও দেখেছিলাম আবারও চোখে পড়ল সেই টিপিক্যাল "কানট্রি সাইড"। কখনো  এক আধটা শহরের মধ্যে ঢুকছে। শহর বলতে নামে, লোকজন,  গাড়ি সবই ভারী কম। ডুরহ্যাম ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে যাবার সময় ময়ূরাক্ষীর ভারী পছন্দ হয়ে গেছিল জায়গাটা। আমার অবশ্য বেশীই ফাঁকা ফাঁকা দ্বীপান্তর মতো  লেগেছে। এমন বলছি অ্যাজ ইফ আমাদের খুব চাকরি অফার করছে এই ইউনিভার্সিটি থেকে! একজায়গায় এসে রাস্তাটা গোঁৎ খেয়ে বাঁ দিকে নেয়। নিলেই ডানদিকে সমুদ্র। হাঁ করে সেই নীল সমুদ্র দেখতে দেখতেই বাঁ দিকে চোখ পড়লে দেখবে মস্ত মস্ত ফার্ম। ভুট্টা আর কি কি সব ফলে আছে, কিন্তু মাইলের পর মাইল কোনো লোক নেই। মানে সত্যিইই নেই। গরু আছে,  ঘোড়া আছে আর আছে একটা বাড়ি। তারপর ধরো বাস পূর্ণগতিতে এগিয়ে চলল, মিনিট কুড়ি যাবার পর ফের একটা বাড়ি। ডাকাতের ভয় টয় নেই? বা অসুস্থ হলে কী হয়? নাকি এতই বড়লোক মানুষজন থাকে এসব বাড়িতে স্বয়ংক্রিয় সব ব্যবস্থা আছে। মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়তো করেনা, সে সত্যি বলতে আমারও সব সময় করে না। মোড়ের মাথায় কচুরির দোকান থাকলে আর এরা দেশ ছেড়ে গিয়ে বিদেশে থাবা পাততো! 

সন্ধ্যের মুখে এডিনব্রা ঢুকলাম। সমতল নয় শহরটা। রাস্তা তাই ঢেউ খেলানো। সস্তায় থাকার জায়গা মানে হস্টেল। এডিনব্রায় অনেক কটা হস্টেলই আছে। আমরা চেয়েছিলাম শহরের মধ্যেই থাকতে কাল আবার ইনভারনেস যাওয়া আছে,  তার জন্যেও বাস স্টেশনে আসতে হবে ফের। তাছাড়া রয়্যাল মাইলে হাঁটা বলো, কিংবা কাসল দেখা বলো,  সবই তো এই ডাউনটাউনেই। সবচেয়ে বিখ্যাত হস্টেল ক্রিস্টোফার ইন।  আমরা  জায়গা পাইনি প্রথম রাতে, পরে থাকবো অবশ্য একদিন। যাইহোক প্রিন্সেস স্ট্রীট জায়গা মিলল। হস্টেলে লিফট নেই।  সে ভয়ানক খাড়াই সিঁড়ি। সৌরভের সুটকেস পুচকে কিন্তু আমাদেরটা বেশ বড়সড়ই। সৌরভ আর আমি মিলে খাড়াই চারতলা তুললাম সুটকেসখানা। আমরা নিয়েছিলাম মিক্সড ডর্ম। ছয়জনের ঘরে আমরা তিনজন। হস্টেলে আগে থাকিনি। কীরকম হবে না হবে সে নিয়ে একটু ভাবনা ছিল। এখন বলা যেতেই পারে কেন বাপু, ইউটিউবে দেখে নিলেই পারতে। অত সময় হয়নি। অফিস, বাড়ি বদল, বাড়ি খোঁজা, ট্যুর প্ল্যান বানানো সব মিলে নাজেহাল হয়েছিল। যাইহোক, প্রিন্সেস স্ট্রীট হস্টেলের ব্যবস্থা খুবই পরিচ্ছন্ন। ক্রিস্টোফার ইনেরও। ধবধবে সাদা চাদর,  বালিশ, তোয়ালে (যদিও আমি ফাইভ স্টারের তোয়ালেও ব্যবহার করিনা, আমার খুঁতখুঁত লাগে)। টয়লেটও খুবই সাফ। স্নানের জায়গাও। কিচেনে ঢুঁ মেরে দেখি অল্পবয়সী একদল খুব রান্না করছে ডিনার করবে বলে। খিদে আমাদেরও পেয়েছিল। ওদের হয়েই এসেছিল। রান্না করছিল মানে পাস্তা বানাচ্ছিলো, একগাদা টমেটো সস দিয়ে।  সৌরভ কালো কফি আর আমরা দুজন কালো চা আর বিস্কুট নিয়ে বসা গেল। খেতে খেতে চারপাশটা দেখছিলাম। দূরের টেবিলে বসে আছে একজন একা। খুব অল্পবয়সী না। আমাদের বয়সী হবে বা একটু বেশী। পাশের দুটো টেবিল জুড়ে দলটা। অল্পবয়সী কিন্তু শান্তিভঙ্গকারি না। নিজেদের মধ্যে হাসি তামাশা করছে কিন্তু অকারণ উচ্চগ্রামে না। দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা। এছাড়া আশেপাশে ঘোরার বা কী কী করা যায় সেসবের লিফলেট আছে। ছেলের দল একবার অফার করল ওদের ওই পাস্তা। দ্রুত ঘটঘট করে না বলেছি তিনজন। ওদের বেশী হয়েছিল, ভালো ভেবে অফার করেছে স্বাভাবিক ব্যপার। কিন্তু যে পদটা বানিয়েছিল তা দৃশ্যতঃ বা গন্ধে খুব উমদা কিছু নয়।

চা কফির পাট চুকিয়ে শহরটায় চক্কর লাগাতে বেরোলাম। এডিনব্রা লন্ডনের মতো নয়, গাড়ি, মানুষ, আলো সবই কম। কাসল, আলো আবছায়া, বৃষ্টি, পাথুরে রাস্তা, নটা বাজতে না বাজতেই দোকানের ঝাঁপ পরে যাওয়া শহর। ঠান্ডা বেশ ভালোই, কিন্তু ডেকাথলনের জ্যাকেটটা কাজে দিচ্ছে ভালোই। রয়্যাল মাইলের দিকেই হাঁটা দিয়েছিলাম। রয়্যাল মাইল হল এডিনব্রার সবচেয়ে বিখ্যাত রাস্তা। লম্বায় এক মাইল এর থেকে কিছু বেশী হবে কারণ স্কটিশ মাইল একটু বেশী। এই রয়্যাল মাইল শেষ  করে আরো বেশ খানিক রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে  সমুদ্র আর রয়্যাল মাইল এর অন্যপ্রান্তে পাহাড়ের মাথায় কাসল। আর রাস্তার দুই পারে রেস্তোরাঁ,  দোকান, চার্চ ইত্যাদি।  শুনে হয়ত ব্যপারটা বোঝা যাবে না। কিন্তু হুড়মুড় করে টাইমমেশিনে সময়টা পিছিয়ে দিয়ে এখনকার মানুষজন জামাকাপড় নিয়ে চলে গেলে যেমন হবে,  সেরকম খানিক। আমরা যখন পৌছলাম, বেশীরভাগ দোকানের ঝাঁপ পরে গেছে। এমনিতেও কাল সকালেই এখানে আসবো আবার। স্যান্ডম্যানের ফ্রি ট্যুর নেব। রয়্যাল মাইল এর চারপাশের সব ঐতিহাসিক জিনিস আমাদের জানাবে। দু:খজনকভাবে, হ্যারি পটারের পান্ডুলিপি লেখার সেই রেস্তোরাঁটা বন্ধ আছে এখন। সেসব বাদ দিয়ে বাকিটা আমরা দেখবো। তারপর বিকেলে চলে যাব ইনভার্নেস। যাই হোক, আজ আমরা টায়ার্ডও বটে। খাওয়া দাওয়া করে নিতে হবে। তা খাবারের দোকান কই হে! একটা দোকানে গেলুম, বলে দাদা মদ আছে বটে কিন্তু খাবার তো নেই! বলে কি অ্যাঁ! এতো আমাদের বাংলা ঠেকের ব্যবস্থা! তা আমাদের পানীয়ের চেয়ে আহার্যের বেশী দরকার ছিল। ফের একটা দোকানে গেলাম, সেখানে খাবার মেলে কিন্তু পড়ে আছে একটা শুকনো মতো বাসী পাঁউরুটি গোছের জিনিস, আর একটা বাসী ছোট্ট মতো প্যাটিস। বিয়্যর আছে অবশ্য। বেশী খোঁজার আর ইচ্ছেও নেই সুতরাং অগতির গতি ম্যাক ডি।

সকালে উঠে তৈরী হয়ে নিচ্ছি। আমরা চেক আউট করে  বেরিয়ে যাব, মালপত্র জমা রেখে। বিকেলে ইনভার্নেস যাবার বাস ধরব। আগেই বলেছি একটা ছয় বাংক রুমের ঘরে আমরা ছিলাম। তা মৃদুস্বরেই কথা বলছিলাম, অন্ধকার বলে আটটা নাগাদ আলো জ্বালিয়েছি, ও বাবা একটা ছেলে যে সৌরভের মাথার উপর শুয়েছিল, ভারী রেগে বকাবকি করতে শুরু করলো। "রাতে তো তোমার জন্যে (সৌরভের জন্যে) ঘুম হল না, এত নাক ডাকিয়েছ।এখন ভোরেও আলো জ্বালাবে। তুমি একটা ডাক্তার কেন দেখাচ্ছো না! " সৌরভটা এত পালোয়ান, মাসল ফুলিয়ে বসে থাকে ব্যাটা মিনমিন করে বলে,  আচ্ছা,  ডাক্তার দেখাবো। বরং ময়ূরাক্ষী বলল, ওহে বাপু তুমি রাতে আলো জ্বালাচ্ছিলে আমার ঘুম ভেঙে গেছিল, আর এখন সকাল আটটা বাজে ভোর না। তাতে চুপ করল। ব্রেকফাস্টের কুপন দিয়ে দিয়েছিল। ওদের রেস্টুরেন্ট নেই। লাগোয়া একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁর কুপন।  কিন্তু বেশ ভালো খাবারের স্বাদ। মোটামুটি গরীব মজুর গোছের লোকেরাই আসছে এখানে খেতে। রেগুলারের ব্যবস্থা মনে হয়। নতুন একটা জিনিস খেলাম, হ্যাগেস। গরু ভেড়া এসবের মাংস দিয়ে বানানো,বেশ খেতে। আশপাশটা দেখতে দেখতে রয়্যাল মাইলে পৌঁছনো গেল। রাস্তায় একটা অটোমেটিক লন মোয়ার দেখে যথারীতি আমরা তিন হাবা হাঁ করে দেখলাম। স্যান্ডম্যান ফ্রি ট্যুর যে পকেট মরুভূমিদের মরুদ্যান আগে বলেছিলাম মনে আছে? এডিনব্রা অতি পুরোনো শহর। এদের পাথরের গলিতে কী ইতিহাস আছে তা জানতে গেলে স্যান্ডম্যান ট্যুর নেওয়া অবশ্যই উচিৎ।  যে ছেলেটি এসেছিল সে হার্বির মতো না হলেও বেশ চমৎকার।  তার থেকেই জানছিলাম, কয়েকশো বছর আগে এরা মোটামুটি আমরা এখন যা, তার থেকেও নোংরা মতো ছিল মশাই! জানলা দিয়ে মল মূত্র ত্যাগ করতো, আর সেসব মনুষ্য পূরীষ দূর হত বৃষ্টির জলে। ওই যে দূরে হ্রদটা দেখা যাচ্ছে ওটায় মানুষের মল মূত্র ছাড়াও কারো হাত কারো মুন্ডু এসব পড়ে থাকতো। যুদ্ধ তো কমন। এ ওকে কাটছে এর মানে লাগছে এর সিংহাসন যাচ্ছে, কারণের অভাব নেই, তাছাড়া এই পাহাড়ি ভেজা জায়গায় যুদ্ধ ছাড়া করবেই বা কী মানুষে! সুতরাং চালাও তলোয়ার দাগো কামান। স্কটল্যান্ড দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে গেছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, হেরে গেছে, ফের লড়েছে তারপর যা হয়, হার স্বীকার করতেই হয় একসময়। লন্ডনে রাজ্যাভিষেক হলেও এডিব্রাতে ফের ওদের অনুষ্ঠান করতে হয় কিন্তু।  ওই আমি "তোমাদেরই লোক" টাইপ ব্যপার দেখানো। আজব আরো আছে, রানী মরার তিনদিন পর নাকি এডিনব্রাতে শোকপালন হয়েছিল।  কারণ? আগেকার দিনে ঘোড়ায় চড়ে আসতে তিনদিন লাগতো তাই! 























 রয়্যাল মাইলেই পথের ধারে আছে ডেভিড হিউমের মূর্তি। মূর্তির বুড়ো আঙুলে সবাই হাত ছুঁয়ে যায়। তাতে নাকি ডেভিড হিউনের মতো জ্ঞান হবে। নাহ খুব একটা এগফেক্টিভ না মনে হয়। কই  কিছু উন্নতি আমাদের তো হয়নি? 



ট্যুর করাচ্ছিল যে ছেলেটা, সে  বলল ম্যাজিক দেখাবে। কী ম্যাজিক? "হুঁ হুঁ দেখতে পাবে।" তারপর সামনে তাকাতে বলার পর তাকাতেই দেখি আরে সত্যিই ম্যাজিক! হগওয়ার্টসেই চলে এসেছি যেন। অবিকল হগওয়ার্টসের মতো একটা চার্চ। 
ওখান থেকে কাসলের সামনে গিয়ে বিস্তর ছবি টবি তোলা হল। কাসলের ভিতরে আর ঢুকিনি আমরা। বহুত দাম।  আমরা কাসলের বদলে গেলুম একটা কবরখানায়। এ কবরখানা থেকেই নাকি বহু নাম রাউলিং জোগাড় করেছিলেন। সত্যিমিথ্যে কে জানে! তবে কবরখানাটা বেশ ভালো। ম্যাপল গাছের পাতায় রঙ ধরা শুরু হয়ে গেছে, শুকনো পাতা ছড়িয়ে পড়েছে কবরের উপর। কত দিনের সব প্রাচীন কবর। মরার পরের জায়গা হিসেবে বেশ উমদা। কে জানে রাতের বেলা স্কচ কিংবা তলোয়ারের উপর খুব আলোচনা হয় কিনা। কংকালদের অবশ্য স্কচ খাওয়ার সুবিধে হবে না, গালে মাংস নেই, খাদ্যনালীও নেই, জিভ নেই, নাহ তলোয়ারে খটাখটিই করা ভিন্ন আর কিছু পারবে না!




 কিন্তু আমাদের তো আর তা না, চা কফি খাদ্য কিছু চাই। সুতরাং চললাম ফিরে। হস্টেলগুলোয় ভারী সুবিধে আছে। সেই সকালে চেক আউট করেছি বটে, কিন্তু তারপরেও কিচেন ব্যবহারে অসুবিধে নেই। নিজের নিজের মতো চা কফি বানিয়ে, টোস্ট আর চিজ দিয়ে লাঞ্চ সেরে ফের বাসস্ট্যান্ডে। যাবো ইনভার্নেস। বাসেই যাবো। সেই সস্তার মেগাবাস। কিন্তু সস্তা হলেও আমরা হলাম গরীব দেশের লোক, ওইই আমাদের কাছে খুউউব ভালো ব্যবস্থা। দোতলা বাসের সামনের তিনখানা সিট দখল করে সামনের আদিগন্ত খোলা মাঠ, পাহাড় দেখতে দেখতে যাওয়া। ইনভার্নেস হল আরো উত্তর দিকে, আরো গাঁ। ফলে আরো পাহাড়, আরো উঁচু, আরো ঠান্ডা, আরো হাওয়া, আরো রহস্য। পুরো স্কটল্যান্ডই রহস্যের আখরা। এদের গল্পে, গানে দৈত্য, দানো, রাজা, যুদ্ধ। বাস চালু হল, আবার সেই মাইল এর পর মাইল ফার্ম কিন্তু লোক নেই, ক্ষেতের পিছনেই পাহাড় আর এই পাহাড়ে মেঘ নেমে এসেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত লাগে না কখনই, মনে হয় তাকিয়েই থাকি। এত ফাঁকা জায়গা দেখতে দেখতে বুকের মধ্যেটা শান্ত মতো হয়ে যায়, তারপর  আস্তে আস্তে দিনের আলো কমে সন্ধ্যে নামে।
ইনভার্নেসে নামলাম যখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে,বৃষ্টিও পড়ছে। যারা নামলো বাস থেকে তারা হুশ হুশ করে কোথায় যেন চলে গেল। ড্রাইভার আর আমরা ছাড়া বাসস্ট্যান্ডে কেউ নেয় আর এখন। এই বাস স্ট্যান্ডটা আমাদের দেশের বাস স্ট্যান্ডের মতো খোলা জায়গায়,  যদিও কাচ দিয়ে ঘেরা জায়গা আছে অপেক্ষার জন্যে। কিন্তু এদেশে মানুষজন এমনিই কম, ইনভার্নেসে আরো।কম, এই বাদলা দিনের  সন্ধ্যেবেলা তাই  ট্রলি, ছাতা, ঠান্ডা হাওয়া আর আমরা তিনজন,  আর ড্রাইভার ছাড়া কেউইই নেই দেখছি। ড্রাইভারের থেকেই আমাদের গন্তব্যস্থলের ডিরেকশন নিয়ে এগোনো এলো। সে আবার অদ্ভুত উচ্চারণে মানে স্কটিশ উচ্চারণে ইংরেজি বলে। কী যে ডিরেকশন দিলো,  কে জানে কী বুঝলাম! আলোঝলমল রাস্তা না, সোডিয়াম ভেপারের অল্প আলো, অচেনা রাস্তা ধরে এগোলাম। রাস্তায় মাঝে মধ্যে একটা আধটা লোক। নির্দেশ অনুযায়ী সামনে এগোলে নদী পড়বে, তার আগে একটা চার্চ। নদী পেরিয়ে আর খানিক গেলেই আমাদের হোমস্টে। চার্চটা আসলে একটা কবরখানার পাশে। এমনিতেই স্কটল্যান্ডের বাতাসে, গলিতে জলে,  রহস্য, ভূত গিজগিজ করছে সেখানে  সম্পূর্ণ অচেনা অজানা তিনটে ছেলে মেয়ে চলেছে গোরস্তানের পাশ দিয়ে একটা মিশকালো আপাত শান্ত নদীর উপর দিয়ে। কে জানে কটা অশরীরী আমাদের নিয়ে মিটিং শুরু করল! হয়তো বলছে ওই দেখ, নতুন লোক রে, ভয় দেখাবি? চল চল তোর সেই স্পেশাল কংকাল ডান্সটা দিই। হয়তো কোনো বুড়ো প্রেত বিরক্ত হয় থামাচ্ছে এই সব অর্বাচীন ছোকরা ভূতেদের যাদের বয়স হয়তো মাত্র শ খানেক! গোরস্তান পেরিয়ে নদীর ব্রিজটা হাঁটার ব্রিজ, ওই পাশে আরেকটা ব্রিজ আছে যেটায় গাড়ি চলাচল করে। ব্রিজে উঠে দেখি অন্ধকারে ফুটে ওঠা আলোয়, চারপাশটা অসম্ভব ভালো লাগছে। ঠান্ডা হাওয়া, বৃষ্টি,  ক্লান্তি সব উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ অনেক্ক্ষণ, চুপ করে। কেউ কথা বলছিলাম না আমরা, স্রেফ নদীর জলের আওয়াজ নিয়ে ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছিলাম।

 অনেক্ষণ পর আমাদের মধ্যেই কেউ বলল, এরপর হোমস্টেতে ঢুকতে না দেয় যদি? সুতরাং ছাতা টুপি সুটকেস লটবহর নিয়ে ফের চলা। যদিও এদেশে রাস্তায় খানাখন্দ থাকেনা বলে সমস্যা হয়না ট্রলি টেনে চলতে, তাছাড়া র‍্যাম্পও থাকে ফলে ফুটপাথ টু রাস্তা বা রাস্তা টু ফুটপাথ এই অংশটাতেও চাপ হয়না। গুগল ম্যাপ বলল।পৌঁছে গেছি, এটাই তো রে? ভয়ে ভয়ে বেল বাজাই। এক স্কটিশ বুড়ো দরজা খুলে দেয়। সব নিয়ম কানুন পরিচয় মিলিয়ে ঘর। গরম আরামদায়ক ঘর। চা কফি কুকিও আছে।।আর আছে অল্প জল। বাকি জল? বাথরুমের কল থেকে ভরতে হবে। এবার কথা হল, বিদেশে সব জলই এক, ওদের রান্নাঘরে যে জল আসে আর বাথরুমে একই পরিশোধিত জল কিন্তু আমাদের তো কোমোডের পাশেই থাকা বেসিন থেকে জল খাবার অভ্যেস নেই! বুড়োকে আমরা সবাই আলাদা আলাদা করে অনুরোধ করলাম,  রান্নাঘর থেকে একটা বোতল ভরে দাও। হারামজাদা কিছুতেই দিল না! এ কেমন হোস্ট রে ভাই। ভাড়া দিয়েছিস যখন অতিথিদের খেয়াল রাখবিনা!  অন্যায্য কিছু তো দাবীও করিনি! এদিকে জলের দোকান তো আর বাড়ির সামনেই না! সুতরাং স্রেফ চা কফি আর কুকি খেয়েই রাত কাটলো।মনের দু:খে! 






3 comments:

  1. তোর লেখাগুলো মন কেমনের ওষুধ রে । ভাই একটাও ভূত দেখলি নাকি ?

    ReplyDelete
  2. প্রদীপ্তAugust 7, 2024 at 9:44 AM

    নাহ, আমরাই মনে হয় ভূত! তাই আর এলো না কেউ!

    ReplyDelete
  3. লিখেছিস বেড়ে 😌বড় হয়ে ঘুত্তে যাব

    ReplyDelete