Sunday, March 14, 2021

অনেকদিন পরে পাহাড়ে(তিন)

 সেই কবে ছায়াতালে মোমো খেতে খেতে থেমেছিলাম। তারপর লম্বা গ্যাপ দিয়েছি। সরি হ্যাঁ? 

সকাল বেলাতেই বেরিয়ে পরবো,  লম্বা পাড়ি দিয়ে দাওয়াইপানি।  ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, কয়েকটা হোমস্টে, গাছপালা জঙ্গলে ঘেরা। দাওয়াইপানি আজকের ইন্টারনেট যুগে অচেনা নাম না, দার্জিলিং এর কাছেই। মুশকিল অন্য জায়গায়, আজকাল কোনো জায়গাই অফবিট নেই, তাই সব জায়গাতেই ভীড়,  "কাল থেকে তো সমানে পাদলা পায়খানা হচ্ছে" ,  বাক্যাংশ শোনা যায় গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে কিংবা উড়ে আসে ব্লুটুথ স্পিকারে টুম্পা সোনা অধিকাংশ জায়গায়। আরেকটা দিকও আছে, যেটা সত্যি বলতে কোভিডের আগে কখনো চোখেও পড়েনি। একটা কম্বলের ওয়্যার পড়াতে খুব এক্সট্রা পয়সা লাগে না খুব কিছু, হোমস্টে গুলোতে সেই কন্সেপ্টই নেই। কেন কে জানে!দাওয়াইপানিতে আমারা থাকবো ঠিক করেছিলাম যখন যে ভদ্রলোকটির সাথে কথা হয়, ফোনের ওপারে ভারী বিনয়ী নম্র এক পাহাড়ি মানুষ। বীরেন রাই এর দু রকম ঘরের একটু বেটার যেটা সেইটায় বুক করেছিলাম মাস দুয়েক আগে প্রায়। ভদ্রলোক ফোনে জানিয়েছেন যে ভালো রাস্তায় কাজ চলাচলের জন্য আটকে আছে, অন্য একটা পাথুরে রাস্তা আছে সেটায় আসা সব ড্রাইভারের জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। কথাবার্তা বলে ঠিক করা গেলো তিনমাইল অব্দি আমরা যাবো নিজেদের ঠিক করা গাড়িতে বাকিটা ও ব্যবস্থা করবে। কালুক থেকে দাওয়াইপানি কম দূর না। বীরেনের মাখন হাত, ঝকঝকে নীল আকাশ, উচ্ছল তিস্তা নদী সে রাস্তা নিমেষে পেরিয়ে যায়। ছেলে ঘুরতে ভালোবাসে, ছবি তুলে বাঁধিয়ে রাখে ঘরে, বন্ধুরা মিলে ঘুরতে গেলে ফূর্তি না করে স্রেফ স্টিয়ারিং এ মন দিতে হওয়ায় ভেবে নিয়েছে এবারে আর নিজে গাড়ি চালিয়ে যাবেনা ঠিক করেছে। হাসিখুশী, নম্র এবং দক্ষ ছেলেটাকে ভারী ভালো লেগেছে। আবার কখনো দেখা হবে কিনা কে জানে!


 তিনমাইল থেকে দাওয়াইপানির রাস্তাটা আহাহা।এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সচরাচর গাড়ির চাকা চলে না বোঝা যায়।দুধারে ঘন জঙ্গল, পাখির ডাকের আওয়াজ শোনা যায় না অবশ্য গাড়ির আওয়াজে। এই রাস্তাটায় আবার আসতে হবে তো পায়ে হেঁটে। দাওয়াইপানিতে কিচ্ছু করার নেই সেইটাই একটা ভালো দিক, পাহাড় দেখো, জঙ্গলে হাঁটো বা গ্রামে ঘোরো ব্যাস। কিন্তু শুরুতেই মুশকিল। বীরেন রাই গেছে গ্রামের লোকের সাথে হাত মিলিয়ে রাস্তা ঠিক করতে,  আর ওর বউ আমাদের ঠিক করা ঘর দিয়ে দিয়েছে অন্য এক দলকে। তারা তো এরকম মওকা পেয়ে আর বেরোবেনা ঘর থেকে। এদিকে অন্য যে ঘরটা দিচ্ছে সেটা বড়ই ঘিজিমিজি মতো, মানে একটা গ্রুপ এসেছে তারা তোয়ালে পরে খালি গায়ে দেখলাম নতুন অফার করা ঘরটার পাশের ঘরটা থেকে বেরোচ্ছে। আমায় আপনারা নাক উঁচু বলতেই পারেন, কিন্তু কিছু জিনিস আমার বরদাস্ত হয়না।  খালি গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে আসা এই দল শিওর রাতের বেলা উল্লাস যাপন করবে মদ খেয়ে  কন্ট্রোল করতে না পেরে বমি করে বা চড়া মিউজিক চালিয়ে। পাহাড় মাখতে  এসে এসব আমার পোষায় না। সুতরাং অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, ওই ঘরে যাবো না। ফোনাফুনি, এক্সপ্ল্যানেইশন ইত্যাদির মাঝে দেখি এক বাঙালী লোক এসে বলছে, "কী হয়েছে?" বাঙালী দেখে নেচে উঠেছি এমন না, কারন বেশীরভাগ সময় বাঙালীরা এসব ক্ষেত্রে অ্যাডজাস্ট করার পরামর্শ দেয়, তাছাড়া উটকো লোককে জবাব দিতেও ভাল্লাগেনা। 




ভদ্রলোক নরম গলায় বললেন, ওনার নাম সূর্য।  এখানেই আড্ডাহাট বলে একটা হোমস্টের মালিক। একবার যদি আমরা দেখে নিই ঘরটা।  সমস্যা যখন হয়েইছে, এটা ওনার গ্রাম, গ্রামের অপবাদ হতে দিতে চাননা বলেই বলা। মুখের উপর না বলা যায় না, পছন্দ না হলে না বলব, একবার দেখেই আসা যাক। আড্ডাহাট একটু উপরে, চড়াই ভাঙতে হয় একটু। পিছন থেকেই  জঙ্গল শুরু। দেখে ভালোই লাগলো। থেকেই যাই নাকি?


 


ভদ্রলোক জানালেন,ওনার বন্ধুরা এসেছে, সময় কাটাতে একসাথে,বোর্ডার আর কেউ নেই তাই কুক ছুটিতে।  মায়াই লাগলো,  বেচারা, তার চেয়েও মায়া লাগলো বন্ধুর বউদের  উপর,  তাদেরই রান্না করতে হচ্ছে কিনা। এক্সট্রা এক জোড়া লোক তাদের দেখাশোনা। কোনো মানে হয়! কিন্তু কোনো রকম অসন্তোষ না রেখেই তারা আমাদের খেয়াল রেখেছিলো একথা না বললে অন্যায় করা হবে। আড্ডাহাট এর একটা লম্বা বারান্দা আছে, সব থেকে কোনের ঘরটা আমাদের ছিলো, বাকি দুটোয় সূর্যবাবুর বন্ধুরা ছিলো, তারা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় ব্যস্ত, নীচে, উপরটা আমাদেরই দখলে বলা যায়। 

কালুকে কেনা পেয়ারা ওয়াইন।দেখতে অবশ্য স্কচের মতো


খেয়ে দেয়ে যে পথে গাড়িতে এসেছিলাম সেই রাস্তাতেই খানিক হাঁটা গেলো। ফিটনেস কমে গেছে খুব। চড়াই ভাঙতে কষ্ট হয়। কেউ কোত্থাও নেই, চেনা অচেনা কিছু পাখিরা ছাড়া। ক্যাঁ ক্যাঁ করে ডাকছে গাছের আড়ালে লুকিয়ে। বনে জন্তু কিছু আছে ছোটো তারাও লুকিয়ে আমাদের দেখছে কিনা কে জানে! এক জায়গায় খেলার মাঠ করা আছে। এতো গুলো গাছ কেটে মাঠ বানালো বলে ভাবতে গিয়ে টের পেলাম এটা ন্যাকামি হচ্ছে, হোমস্টেতে যে থাকছি, সেও গাছ কেটেই গড়ে উঠেছে, এই গ্রামটাই তাই। তা বেচারারা খেলবে কোথায় তাহলে? আবার এই করে ভাবতে গেলে পুরো জঙ্গলটাই সাফ হয়ে যায়! আমাদের এখন সামনে ঢাকতে গেলে পিছন ফাঁক হয়ে যায় আর পিছন ঢাকতে গেলে সামনে দশা। জনসংখ্যা আর লোভ দুইই না কমালে খুব কিছু উপায় নেই। মোটা ল্যাজওয়ালা কালো রঙের কী যেন ফস করে পিছন দিয়ে পার হয়ে গেল!  গা ছমছমে কোনো জন্তু বেশ! ভাবার তো দোষ নেই, দেখতে যখন পাইনি,বন বিড়ালই বা ভাববো কেন শুধু! 

বনপথে হাইক করে ফিরে গ্রামটা একটু ঘুরতে না ঘুরতেই বীরেন রাইজি হাজির হলেন। অত্যন্ত কাঁচুমাচু মুখে বারবার ক্ষমা চাইছিলেন। দেখে মায়াই লাগছিলো, আমরাই উল্টে বললাম আর কি করা যাবে! ক্রমে অন্ধকার নেমে এলো, গাছের ফাঁকে, বারান্দায়। প্রচন্ড ঠান্ডা হলেও ওই নির্জন বারান্দায় আমরা ঝুম হয়ে বসে রইলাম কতক্ষন কে জানে,  অন্ধকারের রঙ বদলালো, হাওয়ার গতি বদলালো, নীচ থেকে সূর্যর নেপালি সহকারী দেশী মুরগী কাটতে নিয়ে যাচ্ছে আওয়াজ এলো, বাচ্ছাগুলোর আওয়াজও ভেসে আসছিলো মাঝে মাঝে কিন্তু সব কিছু ঝাপিয়ে দূর পাহাড়ের জ্বলে ওঠা আলো, আর পিছনের জঙ্গলের শীত জড়িয়ে ছিলো চেয়ারগুলোয়। 

সকালে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি ফের তিনি। যদিও তেমন পরিষ্কার ভিউ না, কিন্তু তাতে আনন্দের কম হয়না কিছু। আর তার সাথে কিচিরমিচির কিচিরমিচির করে একগাদা পাখি তাদের সকালের বাজার হাট, দোকান পাতি করছে। এই দোল খেলো একজন তো ঝটাপটি করলো ওই দুজন, একা বসে রয়েছে আরেকজন ওই ডালে। আমি কাঁচা হাতে একবার ওই দিক আর এই দিক করে খান কতক কে ফ্রেম বন্দী করার চেষ্টা করলাম বটে, তবে তেমন হল কই আর। 







4 comments: