Monday, August 5, 2024

হাইল্যান্ডে (স্কটল্যান্ড প্রথম পর্ব)

লন্ডনে ঘোরার গল্প মুলতুবি রেখে স্কটল্যান্ড ঘোরার গল্প হোক বরং। হ্যাঁ বিস্তর দেরী করছি গল্প শোনাতে। হয়তো আগের গল্পের খেই হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। মানে আদৌ যদি পড়ে আর কি। যাইহোক, আমাদের রেস্তোঁ কম, অল্প সময়ে সব দেখাও যাবে না।  লন্ডন ঘুরেই চলে আসবো তা হবে না। ইংলিশ চ্যানেল পার করলেই ফ্রান্স দেখে আসা যায় কিন্তু শেঞ্জেন ভিসা লাগবে আবার। তাছাড়া শুধু ফ্রান্স দেখে চলে আসলে কীভাবে হবে! তাহলে আরাম করে স্কটল্যান্ডটাই হোক। ইউকেতেই থাকা যাক। 

স্কটল্যান্ড যাবার অনেক উপায় আছে তার মধ্যে সব চেয়ে সস্তা হল বাস। সময় নেয় অনেকটা। প্রায় দশ ঘন্টা মতো। কিন্তু দিব্যি দেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। সত্যি বলতে কি, সকাল বাস ছেড়েছিল কিন্তু আমরা একটুও বোর হইনি সারাটা রাস্তায়। দোতলা বাস। বাসের সামনের সিটগুলো বুক করে রেখেছিলাম আমরা। উঁচু থেকে সবটা দেখতে পাওয়া যায় চমৎকার।  মাঝে কয়েকটা হল্ট দেয়। সাত সকালে সেই হাউন্সলো থেকে ট্রেনে চড়ে লন্ডনে এসে পৌঁছে ভিক্টোরিয়া কোচস্টেশনে এসে পৌঁছনো গেল। এখান থেকেই স্টোনহেঞ্জ যাবার বাস ছেড়েছিল বটে কিন্তু সেটা এক্স্যাক্টলি ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের এদিক থেকে না।  স্টেশন কথাটা কেত মেরে বলছি না, এমনিতেও নামটা তাই আর তাছাড়া বাস ডিপো বললে ব্যপারটা আমাদের ধর্মতলা কি হাওড়া কি শিলিগুড়ি এসব মনে হতে পারে। সে এয়ারপোর্টের মতো ব্যপার প্রায়। সিকিউরিটির ঝামেলা বাদে। বড় বড় স্ক্রীন টাঙানো আছে, লন্ডন থেকে নানান জায়গায় বাস যায়। সমস্ত দূরপাল্লার বাসের ছাড়ার সময় পৌঁছবার সময়,  সব দেওয়া আছে। প্রতিটা বাসের নির্দিষ্ট গেট আছে, সেখান থেকেই তারা ছাড়বে বা সেখানে এসেই থামবে। গেট গুলো আমাদের এয়ারপোর্টের একতলা যেমন ওরকমই। অটোমেটিক কাচের দরজা খুলে বাইরে যেতে পারো কিন্তু ফের ভিতরেই আসতে হবে কারণ সময়ের আগে সেখানটায় অন্য কোনো বাস বা প্যাসেঞ্জারের ভীড় নেই বা ফাঁকা। এদের এখানে লকার রেন্ট পাওয়া যায়। চাইলে কেউ মালপত্র এখানে রেখে সারাদিন ঘুরে নিতে পারে। বাস এলো, বাসের পেটে মালপত্র পুরে নাম মিলিয়ে উঠে জায়গায় বসাও হল।

লন্ডন শহর পেরোতেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যায়। স্টোনহেঞ্জ যাবার সময়ও দেখেছিলাম আবারও চোখে পড়ল সেই টিপিক্যাল "কানট্রি সাইড"। কখনো  এক আধটা শহরের মধ্যে ঢুকছে। শহর বলতে নামে, লোকজন,  গাড়ি সবই ভারী কম। ডুরহ্যাম ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে যাবার সময় ময়ূরাক্ষীর ভারী পছন্দ হয়ে গেছিল জায়গাটা। আমার অবশ্য বেশীই ফাঁকা ফাঁকা দ্বীপান্তর মতো  লেগেছে। এমন বলছি অ্যাজ ইফ আমাদের খুব চাকরি অফার করছে এই ইউনিভার্সিটি থেকে! একজায়গায় এসে রাস্তাটা গোঁৎ খেয়ে বাঁ দিকে নেয়। নিলেই ডানদিকে সমুদ্র। হাঁ করে সেই নীল সমুদ্র দেখতে দেখতেই বাঁ দিকে চোখ পড়লে দেখবে মস্ত মস্ত ফার্ম। ভুট্টা আর কি কি সব ফলে আছে, কিন্তু মাইলের পর মাইল কোনো লোক নেই। মানে সত্যিইই নেই। গরু আছে,  ঘোড়া আছে আর আছে একটা বাড়ি। তারপর ধরো বাস পূর্ণগতিতে এগিয়ে চলল, মিনিট কুড়ি যাবার পর ফের একটা বাড়ি। ডাকাতের ভয় টয় নেই? বা অসুস্থ হলে কী হয়? নাকি এতই বড়লোক মানুষজন থাকে এসব বাড়িতে স্বয়ংক্রিয় সব ব্যবস্থা আছে। মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়তো করেনা, সে সত্যি বলতে আমারও সব সময় করে না। মোড়ের মাথায় কচুরির দোকান থাকলে আর এরা দেশ ছেড়ে গিয়ে বিদেশে থাবা পাততো! 

সন্ধ্যের মুখে এডিনব্রা ঢুকলাম। সমতল নয় শহরটা। রাস্তা তাই ঢেউ খেলানো। সস্তায় থাকার জায়গা মানে হস্টেল। এডিনব্রায় অনেক কটা হস্টেলই আছে। আমরা চেয়েছিলাম শহরের মধ্যেই থাকতে কাল আবার ইনভারনেস যাওয়া আছে,  তার জন্যেও বাস স্টেশনে আসতে হবে ফের। তাছাড়া রয়্যাল মাইলে হাঁটা বলো, কিংবা কাসল দেখা বলো,  সবই তো এই ডাউনটাউনেই। সবচেয়ে বিখ্যাত হস্টেল ক্রিস্টোফার ইন।  আমরা  জায়গা পাইনি প্রথম রাতে, পরে থাকবো অবশ্য একদিন। যাইহোক প্রিন্সেস স্ট্রীট জায়গা মিলল। হস্টেলে লিফট নেই।  সে ভয়ানক খাড়াই সিঁড়ি। সৌরভের সুটকেস পুচকে কিন্তু আমাদেরটা বেশ বড়সড়ই। সৌরভ আর আমি মিলে খাড়াই চারতলা তুললাম সুটকেসখানা। আমরা নিয়েছিলাম মিক্সড ডর্ম। ছয়জনের ঘরে আমরা তিনজন। হস্টেলে আগে থাকিনি। কীরকম হবে না হবে সে নিয়ে একটু ভাবনা ছিল। এখন বলা যেতেই পারে কেন বাপু, ইউটিউবে দেখে নিলেই পারতে। অত সময় হয়নি। অফিস, বাড়ি বদল, বাড়ি খোঁজা, ট্যুর প্ল্যান বানানো সব মিলে নাজেহাল হয়েছিল। যাইহোক, প্রিন্সেস স্ট্রীট হস্টেলের ব্যবস্থা খুবই পরিচ্ছন্ন। ক্রিস্টোফার ইনেরও। ধবধবে সাদা চাদর,  বালিশ, তোয়ালে (যদিও আমি ফাইভ স্টারের তোয়ালেও ব্যবহার করিনা, আমার খুঁতখুঁত লাগে)। টয়লেটও খুবই সাফ। স্নানের জায়গাও। কিচেনে ঢুঁ মেরে দেখি অল্পবয়সী একদল খুব রান্না করছে ডিনার করবে বলে। খিদে আমাদেরও পেয়েছিল। ওদের হয়েই এসেছিল। রান্না করছিল মানে পাস্তা বানাচ্ছিলো, একগাদা টমেটো সস দিয়ে।  সৌরভ কালো কফি আর আমরা দুজন কালো চা আর বিস্কুট নিয়ে বসা গেল। খেতে খেতে চারপাশটা দেখছিলাম। দূরের টেবিলে বসে আছে একজন একা। খুব অল্পবয়সী না। আমাদের বয়সী হবে বা একটু বেশী। পাশের দুটো টেবিল জুড়ে দলটা। অল্পবয়সী কিন্তু শান্তিভঙ্গকারি না। নিজেদের মধ্যে হাসি তামাশা করছে কিন্তু অকারণ উচ্চগ্রামে না। দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা। এছাড়া আশেপাশে ঘোরার বা কী কী করা যায় সেসবের লিফলেট আছে। ছেলের দল একবার অফার করল ওদের ওই পাস্তা। দ্রুত ঘটঘট করে না বলেছি তিনজন। ওদের বেশী হয়েছিল, ভালো ভেবে অফার করেছে স্বাভাবিক ব্যপার। কিন্তু যে পদটা বানিয়েছিল তা দৃশ্যতঃ বা গন্ধে খুব উমদা কিছু নয়।

চা কফির পাট চুকিয়ে শহরটায় চক্কর লাগাতে বেরোলাম। এডিনব্রা লন্ডনের মতো নয়, গাড়ি, মানুষ, আলো সবই কম। কাসল, আলো আবছায়া, বৃষ্টি, পাথুরে রাস্তা, নটা বাজতে না বাজতেই দোকানের ঝাঁপ পরে যাওয়া শহর। ঠান্ডা বেশ ভালোই, কিন্তু ডেকাথলনের জ্যাকেটটা কাজে দিচ্ছে ভালোই। রয়্যাল মাইলের দিকেই হাঁটা দিয়েছিলাম। রয়্যাল মাইল হল এডিনব্রার সবচেয়ে বিখ্যাত রাস্তা। লম্বায় এক মাইল এর থেকে কিছু বেশী হবে কারণ স্কটিশ মাইল একটু বেশী। এই রয়্যাল মাইল শেষ  করে আরো বেশ খানিক রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে  সমুদ্র আর রয়্যাল মাইল এর অন্যপ্রান্তে পাহাড়ের মাথায় কাসল। আর রাস্তার দুই পারে রেস্তোরাঁ,  দোকান, চার্চ ইত্যাদি।  শুনে হয়ত ব্যপারটা বোঝা যাবে না। কিন্তু হুড়মুড় করে টাইমমেশিনে সময়টা পিছিয়ে দিয়ে এখনকার মানুষজন জামাকাপড় নিয়ে চলে গেলে যেমন হবে,  সেরকম খানিক। আমরা যখন পৌছলাম, বেশীরভাগ দোকানের ঝাঁপ পরে গেছে। এমনিতেও কাল সকালেই এখানে আসবো আবার। স্যান্ডম্যানের ফ্রি ট্যুর নেব। রয়্যাল মাইল এর চারপাশের সব ঐতিহাসিক জিনিস আমাদের জানাবে। দু:খজনকভাবে, হ্যারি পটারের পান্ডুলিপি লেখার সেই রেস্তোরাঁটা বন্ধ আছে এখন। সেসব বাদ দিয়ে বাকিটা আমরা দেখবো। তারপর বিকেলে চলে যাব ইনভার্নেস। যাই হোক, আজ আমরা টায়ার্ডও বটে। খাওয়া দাওয়া করে নিতে হবে। তা খাবারের দোকান কই হে! একটা দোকানে গেলুম, বলে দাদা মদ আছে বটে কিন্তু খাবার তো নেই! বলে কি অ্যাঁ! এতো আমাদের বাংলা ঠেকের ব্যবস্থা! তা আমাদের পানীয়ের চেয়ে আহার্যের বেশী দরকার ছিল। ফের একটা দোকানে গেলাম, সেখানে খাবার মেলে কিন্তু পড়ে আছে একটা শুকনো মতো বাসী পাঁউরুটি গোছের জিনিস, আর একটা বাসী ছোট্ট মতো প্যাটিস। বিয়্যর আছে অবশ্য। বেশী খোঁজার আর ইচ্ছেও নেই সুতরাং অগতির গতি ম্যাক ডি।

সকালে উঠে তৈরী হয়ে নিচ্ছি। আমরা চেক আউট করে  বেরিয়ে যাব, মালপত্র জমা রেখে। বিকেলে ইনভার্নেস যাবার বাস ধরব। আগেই বলেছি একটা ছয় বাংক রুমের ঘরে আমরা ছিলাম। তা মৃদুস্বরেই কথা বলছিলাম, অন্ধকার বলে আটটা নাগাদ আলো জ্বালিয়েছি, ও বাবা একটা ছেলে যে সৌরভের মাথার উপর শুয়েছিল, ভারী রেগে বকাবকি করতে শুরু করলো। "রাতে তো তোমার জন্যে (সৌরভের জন্যে) ঘুম হল না, এত নাক ডাকিয়েছ।এখন ভোরেও আলো জ্বালাবে। তুমি একটা ডাক্তার কেন দেখাচ্ছো না! " সৌরভটা এত পালোয়ান, মাসল ফুলিয়ে বসে থাকে ব্যাটা মিনমিন করে বলে,  আচ্ছা,  ডাক্তার দেখাবো। বরং ময়ূরাক্ষী বলল, ওহে বাপু তুমি রাতে আলো জ্বালাচ্ছিলে আমার ঘুম ভেঙে গেছিল, আর এখন সকাল আটটা বাজে ভোর না। তাতে চুপ করল। ব্রেকফাস্টের কুপন দিয়ে দিয়েছিল। ওদের রেস্টুরেন্ট নেই। লাগোয়া একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁর কুপন।  কিন্তু বেশ ভালো খাবারের স্বাদ। মোটামুটি গরীব মজুর গোছের লোকেরাই আসছে এখানে খেতে। রেগুলারের ব্যবস্থা মনে হয়। নতুন একটা জিনিস খেলাম, হ্যাগেস। গরু ভেড়া এসবের মাংস দিয়ে বানানো,বেশ খেতে। আশপাশটা দেখতে দেখতে রয়্যাল মাইলে পৌঁছনো গেল। রাস্তায় একটা অটোমেটিক লন মোয়ার দেখে যথারীতি আমরা তিন হাবা হাঁ করে দেখলাম। স্যান্ডম্যান ফ্রি ট্যুর যে পকেট মরুভূমিদের মরুদ্যান আগে বলেছিলাম মনে আছে? এডিনব্রা অতি পুরোনো শহর। এদের পাথরের গলিতে কী ইতিহাস আছে তা জানতে গেলে স্যান্ডম্যান ট্যুর নেওয়া অবশ্যই উচিৎ।  যে ছেলেটি এসেছিল সে হার্বির মতো না হলেও বেশ চমৎকার।  তার থেকেই জানছিলাম, কয়েকশো বছর আগে এরা মোটামুটি আমরা এখন যা, তার থেকেও নোংরা মতো ছিল মশাই! জানলা দিয়ে মল মূত্র ত্যাগ করতো, আর সেসব মনুষ্য পূরীষ দূর হত বৃষ্টির জলে। ওই যে দূরে হ্রদটা দেখা যাচ্ছে ওটায় মানুষের মল মূত্র ছাড়াও কারো হাত কারো মুন্ডু এসব পড়ে থাকতো। যুদ্ধ তো কমন। এ ওকে কাটছে এর মানে লাগছে এর সিংহাসন যাচ্ছে, কারণের অভাব নেই, তাছাড়া এই পাহাড়ি ভেজা জায়গায় যুদ্ধ ছাড়া করবেই বা কী মানুষে! সুতরাং চালাও তলোয়ার দাগো কামান। স্কটল্যান্ড দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে গেছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, হেরে গেছে, ফের লড়েছে তারপর যা হয়, হার স্বীকার করতেই হয় একসময়। লন্ডনে রাজ্যাভিষেক হলেও এডিব্রাতে ফের ওদের অনুষ্ঠান করতে হয় কিন্তু।  ওই আমি "তোমাদেরই লোক" টাইপ ব্যপার দেখানো। আজব আরো আছে, রানী মরার তিনদিন পর নাকি এডিনব্রাতে শোকপালন হয়েছিল।  কারণ? আগেকার দিনে ঘোড়ায় চড়ে আসতে তিনদিন লাগতো তাই! 























 রয়্যাল মাইলেই পথের ধারে আছে ডেভিড হিউমের মূর্তি। মূর্তির বুড়ো আঙুলে সবাই হাত ছুঁয়ে যায়। তাতে নাকি ডেভিড হিউনের মতো জ্ঞান হবে। নাহ খুব একটা এগফেক্টিভ না মনে হয়। কই  কিছু উন্নতি আমাদের তো হয়নি? 



ট্যুর করাচ্ছিল যে ছেলেটা, সে  বলল ম্যাজিক দেখাবে। কী ম্যাজিক? "হুঁ হুঁ দেখতে পাবে।" তারপর সামনে তাকাতে বলার পর তাকাতেই দেখি আরে সত্যিই ম্যাজিক! হগওয়ার্টসেই চলে এসেছি যেন। অবিকল হগওয়ার্টসের মতো একটা চার্চ। 
ওখান থেকে কাসলের সামনে গিয়ে বিস্তর ছবি টবি তোলা হল। কাসলের ভিতরে আর ঢুকিনি আমরা। বহুত দাম।  আমরা কাসলের বদলে গেলুম একটা কবরখানায়। এ কবরখানা থেকেই নাকি বহু নাম রাউলিং জোগাড় করেছিলেন। সত্যিমিথ্যে কে জানে! তবে কবরখানাটা বেশ ভালো। ম্যাপল গাছের পাতায় রঙ ধরা শুরু হয়ে গেছে, শুকনো পাতা ছড়িয়ে পড়েছে কবরের উপর। কত দিনের সব প্রাচীন কবর। মরার পরের জায়গা হিসেবে বেশ উমদা। কে জানে রাতের বেলা স্কচ কিংবা তলোয়ারের উপর খুব আলোচনা হয় কিনা। কংকালদের অবশ্য স্কচ খাওয়ার সুবিধে হবে না, গালে মাংস নেই, খাদ্যনালীও নেই, জিভ নেই, নাহ তলোয়ারে খটাখটিই করা ভিন্ন আর কিছু পারবে না!




 কিন্তু আমাদের তো আর তা না, চা কফি খাদ্য কিছু চাই। সুতরাং চললাম ফিরে। হস্টেলগুলোয় ভারী সুবিধে আছে। সেই সকালে চেক আউট করেছি বটে, কিন্তু তারপরেও কিচেন ব্যবহারে অসুবিধে নেই। নিজের নিজের মতো চা কফি বানিয়ে, টোস্ট আর চিজ দিয়ে লাঞ্চ সেরে ফের বাসস্ট্যান্ডে। যাবো ইনভার্নেস। বাসেই যাবো। সেই সস্তার মেগাবাস। কিন্তু সস্তা হলেও আমরা হলাম গরীব দেশের লোক, ওইই আমাদের কাছে খুউউব ভালো ব্যবস্থা। দোতলা বাসের সামনের তিনখানা সিট দখল করে সামনের আদিগন্ত খোলা মাঠ, পাহাড় দেখতে দেখতে যাওয়া। ইনভার্নেস হল আরো উত্তর দিকে, আরো গাঁ। ফলে আরো পাহাড়, আরো উঁচু, আরো ঠান্ডা, আরো হাওয়া, আরো রহস্য। পুরো স্কটল্যান্ডই রহস্যের আখরা। এদের গল্পে, গানে দৈত্য, দানো, রাজা, যুদ্ধ। বাস চালু হল, আবার সেই মাইল এর পর মাইল ফার্ম কিন্তু লোক নেই, ক্ষেতের পিছনেই পাহাড় আর এই পাহাড়ে মেঘ নেমে এসেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত লাগে না কখনই, মনে হয় তাকিয়েই থাকি। এত ফাঁকা জায়গা দেখতে দেখতে বুকের মধ্যেটা শান্ত মতো হয়ে যায়, তারপর  আস্তে আস্তে দিনের আলো কমে সন্ধ্যে নামে।
ইনভার্নেসে নামলাম যখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে,বৃষ্টিও পড়ছে। যারা নামলো বাস থেকে তারা হুশ হুশ করে কোথায় যেন চলে গেল। ড্রাইভার আর আমরা ছাড়া বাসস্ট্যান্ডে কেউ নেয় আর এখন। এই বাস স্ট্যান্ডটা আমাদের দেশের বাস স্ট্যান্ডের মতো খোলা জায়গায়,  যদিও কাচ দিয়ে ঘেরা জায়গা আছে অপেক্ষার জন্যে। কিন্তু এদেশে মানুষজন এমনিই কম, ইনভার্নেসে আরো।কম, এই বাদলা দিনের  সন্ধ্যেবেলা তাই  ট্রলি, ছাতা, ঠান্ডা হাওয়া আর আমরা তিনজন,  আর ড্রাইভার ছাড়া কেউইই নেই দেখছি। ড্রাইভারের থেকেই আমাদের গন্তব্যস্থলের ডিরেকশন নিয়ে এগোনো এলো। সে আবার অদ্ভুত উচ্চারণে মানে স্কটিশ উচ্চারণে ইংরেজি বলে। কী যে ডিরেকশন দিলো,  কে জানে কী বুঝলাম! আলোঝলমল রাস্তা না, সোডিয়াম ভেপারের অল্প আলো, অচেনা রাস্তা ধরে এগোলাম। রাস্তায় মাঝে মধ্যে একটা আধটা লোক। নির্দেশ অনুযায়ী সামনে এগোলে নদী পড়বে, তার আগে একটা চার্চ। নদী পেরিয়ে আর খানিক গেলেই আমাদের হোমস্টে। চার্চটা আসলে একটা কবরখানার পাশে। এমনিতেই স্কটল্যান্ডের বাতাসে, গলিতে জলে,  রহস্য, ভূত গিজগিজ করছে সেখানে  সম্পূর্ণ অচেনা অজানা তিনটে ছেলে মেয়ে চলেছে গোরস্তানের পাশ দিয়ে একটা মিশকালো আপাত শান্ত নদীর উপর দিয়ে। কে জানে কটা অশরীরী আমাদের নিয়ে মিটিং শুরু করল! হয়তো বলছে ওই দেখ, নতুন লোক রে, ভয় দেখাবি? চল চল তোর সেই স্পেশাল কংকাল ডান্সটা দিই। হয়তো কোনো বুড়ো প্রেত বিরক্ত হয় থামাচ্ছে এই সব অর্বাচীন ছোকরা ভূতেদের যাদের বয়স হয়তো মাত্র শ খানেক! গোরস্তান পেরিয়ে নদীর ব্রিজটা হাঁটার ব্রিজ, ওই পাশে আরেকটা ব্রিজ আছে যেটায় গাড়ি চলাচল করে। ব্রিজে উঠে দেখি অন্ধকারে ফুটে ওঠা আলোয়, চারপাশটা অসম্ভব ভালো লাগছে। ঠান্ডা হাওয়া, বৃষ্টি,  ক্লান্তি সব উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ অনেক্ক্ষণ, চুপ করে। কেউ কথা বলছিলাম না আমরা, স্রেফ নদীর জলের আওয়াজ নিয়ে ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছিলাম।

 অনেক্ষণ পর আমাদের মধ্যেই কেউ বলল, এরপর হোমস্টেতে ঢুকতে না দেয় যদি? সুতরাং ছাতা টুপি সুটকেস লটবহর নিয়ে ফের চলা। যদিও এদেশে রাস্তায় খানাখন্দ থাকেনা বলে সমস্যা হয়না ট্রলি টেনে চলতে, তাছাড়া র‍্যাম্পও থাকে ফলে ফুটপাথ টু রাস্তা বা রাস্তা টু ফুটপাথ এই অংশটাতেও চাপ হয়না। গুগল ম্যাপ বলল।পৌঁছে গেছি, এটাই তো রে? ভয়ে ভয়ে বেল বাজাই। এক স্কটিশ বুড়ো দরজা খুলে দেয়। সব নিয়ম কানুন পরিচয় মিলিয়ে ঘর। গরম আরামদায়ক ঘর। চা কফি কুকিও আছে।।আর আছে অল্প জল। বাকি জল? বাথরুমের কল থেকে ভরতে হবে। এবার কথা হল, বিদেশে সব জলই এক, ওদের রান্নাঘরে যে জল আসে আর বাথরুমে একই পরিশোধিত জল কিন্তু আমাদের তো কোমোডের পাশেই থাকা বেসিন থেকে জল খাবার অভ্যেস নেই! বুড়োকে আমরা সবাই আলাদা আলাদা করে অনুরোধ করলাম,  রান্নাঘর থেকে একটা বোতল ভরে দাও। হারামজাদা কিছুতেই দিল না! এ কেমন হোস্ট রে ভাই। ভাড়া দিয়েছিস যখন অতিথিদের খেয়াল রাখবিনা!  অন্যায্য কিছু তো দাবীও করিনি! এদিকে জলের দোকান তো আর বাড়ির সামনেই না! সুতরাং স্রেফ চা কফি আর কুকি খেয়েই রাত কাটলো।মনের দু:খে! 






Saturday, June 8, 2024

লন্ডন ডায়রি (ওয়ার মিউজিয়াম)

একদিন গেলাম ওয়ার মিউজিয়ামে। লন্ডনে মিউজিয়াম গুলো ঘুরে বেরালেই চমৎকার ইতিহাস জানা যায়। দু:খজনকভাবে কোলকাতা মিউজিয়ামটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।  আরেকটু যত্ন আত্তি কেন করে না বলে বড় আপশোস করেছি। আলিবাবা চল্লিশ চোরের গুহা মানে ব্রিটিশ মিউজিয়াম নিয়ে অন্য পোস্টে লিখবোখন। যাই হোক, ওয়ার হিস্ট্রি নিয়ে আমি খুব উৎসাহী না। মানে এই বন্দুক, ওই যুদ্ধাস্ত্র এসব অমুক জায়গায় ব্যবহার হয়্রছে দেখলাম ঠিক আছে বরং ওই সময়ের লোকেদের কেমন অবস্থা ছিল জানতে বেশী ভালো লাগে। এনিশিয়েন্ট হিস্ট্রির জিনিসপত্র দেখলে বেশী বিস্মিত হই আর কি। যাইহোক এটা সেটা পার করে গেলাম হলোকাস্ট গ্যালারি দেখতে। জানি মোটামুটি সবাই তাও চোখের সামনে ওই বীভৎস হত্যাকান্ডের ছবি দেখলে একটু নড়ে যেতে হয়। কী ছিল থেকে কী হল অব্দি দেখিয়েছে ওরা। বিভিন্ন ফিল্ম,  রেকর্ডিংস,  ক্লিপিংস। মানে এতটাই খারাপ করেছিল, ব্রিটিশ সেনা যারা ওখানে গিয়েছিল তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখছিলাম মারাত্মক। বিবিসির যে রিপোর্টার এটা দেখে বলছিল, প্রথমে তার কথা কেউ বিশ্বাসই করেনি। ছয় মিলিয়ন জিউশ মেরে ফেলেছিল!! ছয় মিলিয়ন শুনে আমি কর গুনতে থাকি, ষাট লক্ষ! এতগুলো লোককে স্রেফ "অপর" বলে মেরে ফেললো!! যা খুশী তাই করেছে, যেভাবে খুশী অত্যাচার করেছে। আসলে ওদের মানুষ বলেই ভাবেনি। গুলি করেছে বিবস্ত্র করে একদলকে, সেই উলঙ্গ মৃতদেহের উপরে শুইয়ে, পরের উলঙ্গ দলকে গুলি করেছে। কাউকে বলে কাজের জন্যে নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে গিয়ে গুলি করেছে। কোনো দলকে জ্যান্ত জ্বালিয়েছে। বিবিসির ওই লোকের ভয়েস রেকর্ডিং শুনছিলাম। বলছে, মানুষগুলো বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটা বুঝতেও বেগ পেতে হচ্ছিলো, যেন পালিশ করা স্কেলিটন বলে মনে হচ্ছিলো।

 কত হাতে লেখা চিঠি। কেউ স্ত্রীকে ছেড়ে যাচ্ছে মানে বাধ্য হচ্ছে কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে যেতে, কেউ স্বামীকে কেউ বাবা মাকে মিস করে চিঠি লিখছে। একটা বাচ্ছার চিঠি ছিল, সে দাদু ঠাকুমার সাথে ছিল, তার বাবা মা থিয়েটার করতে রাশিয়া গেছিল। সে লিখছে বাবা মা'কে সে খুব মিস করছে, অনেক কেক খাচ্ছে। নতুন স্কুলে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তার ঠাকুমা লিখছে এত কেক খেয়ে এবার সে হয়তো ওয়েট গেন করবে। এ চিঠির কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।বিবিসির ওই ভদ্রলোকের রেকর্ডিংের একটা জায়গায় বলছে, যখন ব্রিটিশ সেনারা যায় তখন তাদের কাছে এক মা তার বাচ্ছার জন্যে দুধ চাইছে কারন তার বুকে আর দুধ নেই। তাই  বাচ্ছাটা খেতে পাচ্ছে না। তারপর,  বাচ্ছাটাকে যখন নামিয়ে রেখেছে, খুলে দেখে বাচ্ছাটা অনেকদিন আগেই মরে গেছে, তার মা টের পায়নি, কিংবা পেয়েছে!

 গ্যালারিটা শুরু হয় একটা হাসিখুশী আনন্দের ছবি দিয়ে। ইউহুদিরা কেমন ছিল, পিকনিক, সাঁতার, হাসি তামাশার দিন, ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিকটাও ওরকম। আস্তে আস্তে এগোই, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বদলে যায়। চাপা টেনশনের মিউজিক চলে। প্রথম ক্রিপল্ড,মেন্টলি ডিস্যাব্লড বাচ্চাদের বেটার শেলটার দেবে বলে, নিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা খুশী, ভালো হবে।  আমার সন্তানের ভালো চায়। তারপর? ক্লিপিংস আসে, তাদের চান করিয়ে, খেলবে বলে দরজা বন্ধ করে দেয়।  ইউথেনশিয়া করে দিল কারন এরা রাষ্ট্রের বোঝা! অবশ্য তার আগে লোকজনের মধ্যে প্রচার করেছিল, এত টাকা, জনগনের ট্যাক্সের টাকা যাচ্ছে স্রেফ এই সব বাচ্ছাদের জন্যে!  ভাবো এই টাকায় তোমাদের কত উন্নতি হত! 

টেনশন মিউজিক বাড়তে থাকে। পট পরিবর্তন হল, ন্যাশনাল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলো। ক্রমে ইহুদিদের ঘেটো করে আলদা করা হচ্ছে, ইহুদি মরে পড়ে থাকছে, সাধারণ লোকে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। ওই যে ক্যাম্প, ওই যে উলঙ্গ হাড় সর্বস্ব পুরুষ মহিলার পাহাড় এ একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে অবিশ্বাস, পারস্পরিক ঘৃনা, ইগ্নোরেন্স, মিথ্যে সব কিছু দিয়ে হয়েছে।
ব্রিটিশরা নিজেরাও কম হারামি না, ওই সময়েই চার্চিল আমাদের দেশের তিন লক্ষ লোককে মেরেছিল না খেতে দিয়ে। সেটা যে লিখেছে সেটাই ভালো। নিজেদের দোষ স্বীকার করার মতো সভ্য হয়েছে অন্তত। ইহুদিরা যখন দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছিল, আমেরিকা, ইংল্যান্ড কেউ ওদের জায়গা দেয়নি। তাহলে হয়তো সং্খ্যাটা কিছু কম হত! সেটাও লিখেছে, লুকিয়ে যায়নি। 

ওয়ার মিউজিয়ামের বাইরে একটা মস্তো কামান আছে। কোন যুদ্ধে যেন ব্যবহার করা হয়েছিল। তার সামনেই বাগান, সেখানে দেখি একটা গোলাপ ফুটেছে। ঠিক কামানটার সামনেই৷ 

Saturday, April 13, 2024

চৈত্রের দিন

চৈত্র মাস সেলের বাজার ছাড়া কেউ খবর রাখে না। আর আজকাল সারাবছরের সেলে চৈত্রসেলের তেমন দাম আছে কিনা কে জানে। কেনাকাটায় আমার তেমন আকর্ষন নেই বলেই সেলের সাথে আমার যোগাযোগ কম। চৈত্র আমার কাছে অবশ্য ফালতু হয়ে যায়নি। ফাল্গুন চৈত্র বৈশাখ...লোকে গরমে ভাজা ভাজা হয়ে রোদ্দুরকে গাল পাড়ে। ফেসবুকে ইভেন্ট হয়, যারা গরম ভালোবাসে বলেছে তাদের পে টা নো হবে,  চিতায় ছোঁড়া হবে। অবাক হয়ে দেখি! ভালোবাসতে হবে না, কিন্তু এরকম মারমুখী হতে হয় বুঝি? তামাশা করেও?! আমি সেই কতিপয় লোকের মধ্যেই যারা এই তীব্র দাবদাহ ভালোবাসে। বাংলা গরমের মাসগুলোর মতোই অর্বাচীন লোক। গোটা চৈত্র মাস আমি বেলার ঝাঁ ঝাঁ রোদে সাইকেল নিয়ে বাজার যাবার নামে বেরিয়েছি, রাস্তাঘাট বেবাক ফাঁকা, গোলাপী, বেগুনী, লাল, হলুদ, চড়া রঙের রোদের মতোই চড়া রঙের ফুল। গাছের নীচে ফুল বিছিয়ে জায়গাটা রঙীন জাজিমের মতো করে রেখেছে। রোদের ঝাঁঝ এসে লাগে, রোদের গন্ধও। বারান্দার গাছগুলোয় কবে এক পাখি খাওয়া বীজ থেকে নিম গাছ হয়েছিল। এ বছর গাছটার সব পাতা ঝরে গেছিলো, শুকনো কাঠের মতো ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সবার আড়ালে ফিসফিস করে বলতাম, বেঁচে যা ভাই। মরে গেলে দু:খ হবে খুব। সবার হবে, কারিপাতাটার, চন্দন গাছটার, জবাটার। আগের জবা গাছটার দু:খেই এরকম হল কিনা কে জানে। মালীটার জোর করে আগের জবা গাছটা মারলো। আজও আপশোষ হয়, কেন ওর কথা শুনলাম।  রাগ করিস না বাপ, সেরে ওঠ। তারপর, যেদিন দেখলাম, একটা দুটো করে পাতার আভাস দেখা যাচ্ছে সেও তো চৈত্রের একটা দিনই। ফূর্তির যে এমন কচি সবুজ রঙ হয় কে জানতো! গোলাপ গাছটা মরেই গেল। এই গোলাপ গাছটার সাথেও আমার কথা বার্তা হত এক সময়। বারান্দায় গেলেই, কোথাও কিচ্ছু নেই, হাওয়া দিত এক ঝলক, কেউ বিশ্বাস করবে না,  কিন্তু আমি জানি, গোলাপ গাছটাই বলতো হাওয়াকে। না হলে আশপাশের বাড়ির কোথাও গাছের পাতা নড়তো না কেন? 

সেদিন ঈদের দিন সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি।  আশপাশের দোকান সব বন্ধ, একটু এগোলেই  শহর শেষ। বাঁশবনের রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে তার ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাচ্ছে মনে হয়। বাবার কাছেই হবে, না হলে মেয়েটার এমন কিশোরী বা বালিকার মতো খুশী মুখ হতোই না। আর সাথে ওই যে ব্যগে নির্ঘাত মিষ্টি কিংবা ঈদের উপহার। ঈদে কি মেয়েরা তার বাপের বাড়ি যায়? পুজোয় যেমন আসে? নাকি আমার বুঝতে ভুল হচ্ছে! কত কম জানি! এই যে চড়ক উপলক্ষে গ্রামের প্রায় সব মেয়ে পুরুষ নতুন গামছা, একটা নতুন পৈতে পরে বেরিয়ে পড়েছে। ভিক্ষে  চেয়ে, নিরামিষ খেয়ে, মাটিতে শুয়ে কৃচ্ছসাধন করে। এ আমি জানতাম তবে এরকম পাড়া জুড়ে সবাইকে করতে দেখিনি। অবশ্য আদতে  চড়ক তো বাবুলোকদের উৎসব ছিলোও না কখনো। 
কিছুদিন আগে,  একটা আশ্চর্য জায়গায় গিয়েছিলাম। নেটওয়ার্কহীন, শব্দহীন সে আশ্চর্য জায়গা। ভরদুপুরে হুট করে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে রোদের হলকা সয়ে গেলে সরসর করে পাতা পড়ার শব্দ ভিন্ন আর কিচ্ছু কানে আসবে না। মনে হিবে যেন কোন আদিম সময়ে একা দাঁড়িয়ে। রাত বাড়লে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে পালিয়ে আসা কোনো ব্যঙ বসে থাকবে জলের কলের উপর, দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে। হাজার বললেও সে যাবে না কিছুতেই। তারপর ভোরবেলায়, মানুষেরা যখন ঘুমিয়ে পড়বে, তার মা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে এক থালা পোকা ধরে দেবে। সন্ধ্যেবেলা মহুয়ায় মাতাল শবরীর সাথে ভোজ খেতে যাওয়া কুকুর ছানা মহুয়ার গন্ধে রাস্তা গোলমাল করে বেপাড়ায় হাজির হবে। তারপর?  তারপর এই মাতাল সেই সুস্থ এরকম নানান জনের সাথে ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরে সে কী গল্প! "জানো মা আজ না.....। "
মাঝে মাঝে কোলকাতার বাইরে থাকি।  এ জায়গাটাও রোদ গরমের জন্যে বিখ্যাত। আমার কিছু আসে যায় না অবশ্য।কোকিল গুলো সাত সকালে ক্যাচোরম্যাচোর লাগিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে সকালটা লম্বা করে দেয়। ব্যাটাদের সকাল থেকে প্রেম পায় দেখি। সেদিন বেলার দিকে সে কি লটাপটি ঝগড়া! দুটো কাক মারামারি করে গাছ থেকে পরেও ঝটাপটি করছে। সারা পাড়ার কাক চলে এসেছে  লড়াই দেখতে। আরে আরে, একটা কাঠবিড়ালি তুরতুর করে লাফাতে লাফাতে আমার সাইকেলের সামনে, ব্রেক কষতে কষতে সে হাওয়া। সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যে প্রতিটা সময়ের দিনের যে নিজস্ব গান তা শুনতে শুনতে নেশা ধরে। দুপুরের কুবো পাখিটার ডাক শুনতে পেলে আমার আর হিসেব নিকেশ মেলাতে ভাল্লাগেনা। মনে হয় এক্ষুনি সব ছেড়ে না বেরোলে যেন হবে না, কোথায় কোন দূরে যেতে হবে আমায়, সময় বয়ে যাচ্ছে।

এখানে অবাঙালী ভীড় খুব, হনুমান মন্দির হচ্ছে আরো বড় করে। মন্দিরটার দুপাশে দুটো বড় বড় গাছ ছিল, বট আর নিম। কেটে দিলো। মন্দির বড় হবে। সকাল বিকেল বেচারি হনুমানগুলো লাফ ঝাঁপ করে যায় ক্যাম্পাসের মধ্যেই তাই৷  
ধূ ধূ দুপুরের জনপ্রানীহীন বন প্রান্তর, শুনশান রাস্তা, রোদের তাতে নিস্তেজ হয়ে ছায়ার আরাম, কচি পাতার রঙের বাহারে জঙ্গলে রঙের আগুন লেগে যাওয়া বসন্ত, গ্রীষ্ম আমায় বুঁদ করে দেয় ভালোলাগায়। রোদ লেগে শরীর খারাপ হয়, বন্ধুরা তামাশা করে কিন্তু শরীর তো শরীরের নিয়মে চলবে ভালোবাসতে গেলে কী অত বেছে ভালোবাসা যায়!?

Friday, January 19, 2024

লন্ডন ডায়রি (তিন)

অফিসের পর বেরিয়েছি। যাই কোথাও টুক করে ঘুরে আসি। কাল শনিবার। একটু দেরী হলেও ক্ষতি নেই। ক্যাম্পডেন মার্কেটটা শুনেছিলাম বেশ। বেশ মানে কি আর আমি বিরাট কিনিয়ে কেউ। কিছুই না হরেক মানুষ, হরেক রকম দেখা যাবে এই আর কি। তায় মার্কেটটা যে জায়গায় সে জায়গাটাও সুন্দর। অবশ্য আমার প্রায় সবই ভালো লাগছে, নতুন জায়গায়। টিউব থেকে বেরোলে একটা অন্য রকম ভাইব চোখে পরবে। দোকান টোকান তো আছেই, কিন্তু চারিদিকে, বেশ একটা হল্লাগুল্লা পরিবেশ। ক্যাম্পডেন মার্কেটটা একটা খালের ধারে। বেশ অনেক কটা খাবারের দোকান আছে, চেইন রেস্তোরাঁ নয়। এমনি , ছোট ছোট ভ্যান টাইপ গাড়িতে আর কি। এখানের মার্কেটের দস্তুর অনুযায়ী দোকানের সামনে দিয়ে গেলে টেস্ট করায়। গোটা চার পাঁচ দোকানের চিকেন ভাজা, আর একটা দোকানের ফালাফেল খাওয়া গেলো। খাবার দাবার ছাড়াও, জামা,  হ্যানা ত্যানা নানান দোকান আছে। শপিং মলের মতো না কিন্তু। একটু তফাৎ আছে। শুক্রবারের বিকেল, পাব গুলো ভর্তি হতে শুরু করেছে। হরেক কিসিমের মানুষ। ভারতীয় প্রচুর।  এমনিতে লন্ডনে বাংলাদেশীও প্রচুর কিন্তু এখানে খুব একটা দেখলাম না। একটা তিলের তৈরী কিসব খাবার মিলছে দেখে ঢুঁ মারতে গিয়ে দেখি খুব টেস্ট করাচ্ছে। কোন দেশী হবে? যাই হোক বেড়ে খেতে কিছু ডেজার্ট পাওয়া গেল। যদিও যখন প্রায় কেউই কিনলো না, মেয়েটার মুখটা ম্লান হয়ে গেল দেখে একটু খারাপই লাগছিল , কিন্তু কিনলে আমার ম্লান মুখ হয়ে যাবে।













 আচ্ছা, খালের ধার ধরে সোজা হেঁটে গেলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতে হাঁটতে শুরু করি। একটু এগোলেই ক্যাম্পডেন মার্কেটের আওয়াজ ফিকে হয়ে আসে।খালের ধারের এই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে থাকলে মাথার উপর রিজেন্ট পার্ক পড়বে। এই রিজেন্ট পার্কে পরে একদিন আসবো, ময়ূরাক্ষীর সময় হলে। রিজেন্ট পার্কটা বিরাট। তারপর আরো হাঁটলে একসময় পৌঁছে যাওয়া যাবে লিটল ভেনিস বলে একটা জায়গায়। খালে নৌকা করে ঘোরাঘুরি হয় সেই সুবাদেই নাম আর কি। কোথাও পৌঁছবো বলে হাঁটা শুরু করিনি।এমনিই হাঁটছিলাম। খানিক এগোতে চোখে পড়ে নৌকা বাঁধা আছে, সে নৌকাতেই কিছু মানুষ থাকে।  এদের অবস্থা যে খালের ঐ পারের চমৎকার সব বাড়িতে থাকা লোকের তুলনায় বেশ খারাপ তা বুঝতে বোঝদার না হলেও চলে ।কয়েকজন লোক গাঁজা বা ওই জাতীয় কিছু সেবন করছে। কেউ কেউ গল্প করছে বসে। খালের পাশে রাস্তা তারপর দেওয়াল। দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতি। আরো এগোলে রাস্তা নির্জন হয়ে আসে। মাঝে মাঝে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ,  কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে। দূরে একটা ব্রিজ এদিক থেকে ওদিক গেছে। সবুজে ঢাকা চারপাশ। ব্রিজের নীচে রাজ্যের পায়রায় বাসা। কেউ কোথাও নেই। সন্ধ্যে নেমে এসেছে বেশ।  ব্রিজের উপর থেকে চারপাশটা কেমন অবাস্তব লাগে। লন্ডন শহরের মধ্যে বলে মনে হয়না যেন। 










ব্রিজএর পাশের সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় যাই, এ গলি সে রাস্তা দিয়ে এমনিই হেঁটে হেঁটে যাই। হাঁটতে হাঁটতে লিটিল ভেনিস পৌঁছে গেছি যখন দেখি চারপাশ অন্ধকার। হাঁটার নেশায় হেঁটেছি। এখন মনে হচ্ছে টিউব স্টেশনটা কই । যথারীতি একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে করে চলেছি এবং সকলেই মোটামুটি খুব ভালোভাবে রাস্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। লিটিল ভেনিসের কাছের যে টিউব স্টেশনটা ছিল, নামটা ভুলে গেছি,  একটু হাঁটতে হত।  এলাকাটা পুরো পাকিস্তানি দোকানে ভর্তি। কাবাব, ফল রুটি, বোরখায় ছয়লাপ। এখান থেকে দুবার ট্রেন বদলে পৌঁছবো হাউন্সলো সেন্ট্রাল। বেকারলু  লাইনের ট্রেনে প্রথম উঠলাম।  এটায় আবার মুখোমুখি সিট আছে চারজনের। আচ্ছা ইয়ে আমাদের দেশের মেট্রো গুলো গদি মোড়া করতে খরচ হবে খুব , না? ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে দেখি বেকার স্ট্রিট এলো। এ স্টেশনের গায়ে সাইন দেওয়া থাকে শার্লক হোমসের।  একটা কাল্পনিক  চরিত্র কোন জায়গায় চলে যেতে পারে তাই না?




আরেকদিন গিয়েছিলাম বরো মার্কেটে। সেও এখানকার এক বাজার। এত বাজারে ঘুরছি মানে আমি বিরাট বাজারু তা না।ভালো কথা, লন্ডনের অনেক জায়গার খোঁজই আমি পেয়েছিলাম সুদীপের ব্লগ থেকে। ব্লগ থেমে গেলে, ব্যক্তিগত মেসেজ করে। ময়ূরাক্ষীও অনেক কটা জায়গা নানান জায়গা থেকে বের করেছিল। যাই হোক, যা বলছিলাম, এক মাসের এই ছোট্ট সফরে চেয়েছিলাম বিখ্যাত দ্রষ্ট্রব্য যা পারি দেখবো ঠিক আছে কিন্তু লন্ডন  শহরের হইচই, মানুষ, এসব গুলোও পারলে ঢুঁ মেরে যাবো। সবচেয়ে অবাক লেগেছে, বা আপশোষ হয়েছে, বিশ্বযুদ্ধে এদের বহু বিখ্যাত পুরোনো বাড়িই বোমায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরা ওল্ড সিটি চার্মটা কেমন আবার গড়ে তুলেছে! আর আমরা কেমন নির্দ্বিধায় সবটা নষ্ট করছি। অবশ্য একটা কারন হতে পারে, আমাদের সে পাঁচ হাজার বছর থেকে কত রাজা গজা এলো গেলো, কত সৌধ কত চৈত্য, মন্দির, মসজিদ ভেঙেছে তার উপর শহর গড়েছে, সামান্য একশো দুশো বছর আমাদের কাছে আর তেমন কিছুই না!  অযাচিত বেশী পেলে যা হয় আর কি।  কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম, ছিলাম বরো মার্কেটে। বরো মার্কেট আবার ক্যাম্পডেন মার্কেটের থেকে খানিক আলাদা ধাঁচ। আর ভীড় কী ভয়ানক রে বাবা। যেন সপ্তমীর রাতের দুর্গাপুজোর ভীড়। অবশ্যই খাবারের দোকানের সামনে আর পাবের সামনে। আর কত সব আজব খাবার দাবার। ঝিনুকের সম্ভার নিয়ে বসেছে একজন। একজনের সামনে খুব ভীড়, মাংসের খিচুড়ি টাইপ কিছু বানাচ্ছে, তার মধ্যে ঝিনুক টিনুক দিয়েছে! ওইদিকে জার্মান বেকারি, পাঁউরুটি নিয়ে হাজির। রিসাত্তোর দোকানেও বেজায় ভীড়। আহাহা বেজায় প্রাণ কাড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে? ওহো, ফিশ এন্ড চিপ্স। ভীড়টা এখানেও জব্বর। ওইদিকে হোমমেড  চকলেটের দোকান তো, অন্যদিকে টার্কিশ কফি। পাশের গলিতে আবার ব্রিটিশ হোম মেড পাই। ব্রিটিশরা আলুসেদ্ধ ছাড়া পাই টাই বানাতে জানে! ফলের দোকানও খুব বসেছে। হরেক ফল,  সবজি। 
পুরো জায়গাটায় কাদা আর থুতু বাদ দিলে আমাদের বাজারের সাথে তফাৎ হল দামাদামি হয়না, বা হলেও আমি জানিনা। ওহো আরেকটা তফাৎ, চলে এলে কেউ হাঁক দেবে না, আরে শুনে যান না, বলে। 










বরো মার্কেট থেকে বেরিয়ে, টেমসের ধার ধরে হাঁটছিলাম। এদিকে লন্ডন ব্রিজ থেকে ওই পারে টাওয়ার ব্রিজ। টেমসের পারের রেস্তোরাঁ গুলো বেজায় দামী, বেশ কেতা ওয়ালা লোকজন বসে বসে খাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে যাচ্ছি, ও বাবা আমার গলায় ক্যামেরা দেখে এক মাতালের পাল্লায় পড়েছি। বলে, "আমার একটা ছবি তুলে দাও"।  দেওয়া গেল। কিন্তু তার স্বাভাবিক বুদ্ধি তো গেলাসে ভেসে গেছে। ক্যামেরায় তার ছবি দেখানো হল, তাতে আরো পোজ দিয়ে আমায় ছবি তোলালো একটা। এইবার আমি এগোবো ও বাবা বলে আরো তোলো এই ভাবে। মহা জ্বালা তো,  " আর একটাও তুলে তো দেবোই না, এ গুলোও ডিলিট হবে, যত্তসব গেঁড়ি গুগলির ঝাঁক",  বলে এগোনো গেল। লন্ডনের লোকেরা ফ্রেন্ডলি বলেছি আগে তাই না? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টাওয়ার ব্রিজ খোলা তারপর আবার ভাঁজ হওয়া দেখছি, এমন সময় স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে এক মহিলা বলল,  "তুমি কি একটা ছবি তুলতে চাও? আমি তুলে দেবো তোমার?"। হুঁ হুঁ বলেছি না আমি মানুষটাই দেবদূত টাইপ ভালো হে। 

টিউবের এ গলি ও গলি হাঁটা চলার ফাঁকে চোখে পড়ে গাইয়ে ভিখারি৷ মানে ভিখারি বলা ঠিক না, পারফর্মার। আমাদের দেশে যেমন স্টেশনে,  বা ট্রেনে গান গেয়ে টাকা চায়, তেমনই এরাওদিব্যি পাটি পেতে, বাজনা টাজনা বসিয়ে গান বাজনা করে, আন্ডারগ্রাউন্ডে। কেউ কেউ পাউন্ডও দেয় বটে। একটা স্টেশনে  দু পাশে ইকুয়ালিটি নিয়ে পোস্টার। জেন্ডার ইকুয়ালিটিই মূলতঃ।  একা মা,  দুজন পুরুষ, সমকামী, বিষমকামী, ট্রান্স সবার ইনক্লুশন নিয়ে সুন্দর সুন্দর বক্তব্য দিয়ে।  বেশ লাগলো। কোনো কোনো টিউব স্টেশনে নাটক ইত্যাদির বিজ্ঞাপন থাকে। নাটক আমাদের একটাও দেখা হয়নি, যদিও ব্রিটিশ থিয়েটার মাস্ট ভিজিটসব জায়গায় লেখা ছিল। বেজায় দাম ছিল এক একটা টিকিটের। না হলে হ্যারি পটার এন্ড কার্সড চাইল্ডটা দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল। 











সৌরভ আসার পর একদিন গেলাম শার্লক হোমস মিউজিয়ামটায়। সৌরভের সাথে আমাদের লন্ডন ঘোরা লিমিটেড , এক সপ্তাহ ও থাকার পরেই আমরা স্কটল্যান্ড চলে যাবো । এক সপ্তাহে কমন ছুটি দেখে কিছু জায়গা একসাথে ঘোরার প্ল্যানে রেখেছিলাম। হোমস মিউজিয়ামে তো যেতেই হত। মানছি ওসব খুবই সাজানো ব্যপার আর " সহী" ট্যুরিস্টরা ওসব সাজানো জায়গায় যায় না। কিন্তু আমরা না হয় "ঝুটা" ট্যুরিস্টই হলাম। এ এক দেখার জিনিস হে।একটা বাড়ি কিনে মিউজিয়াম বানাবো বললেই হল না। তাকে ভালোওবাসতে হবে তবেই তুমি ছোট ছোট জিনিসগুলো মাথায় রাখতে পারবে। শার্লকের ঘরের প্রতিটা ডিটেইলস রয়েছে। পিস্তল ছুঁড়ে  বানানো দেওয়ালে অক্ষরটা অব্দি। একটা জাবদা খাতায়,  দেশ বিদেশ থেকে আসা চিঠি সাজানো আছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও পাঠানো চিঠি আছে। এরা সবাই বিশ্বাস করেছে শার্লক হোমস বলে নির্ঘাত কেউ আছে। ওয়াটসনের ডাক্তারির জিনিস থেকে সেফটি রেজার অব্দি আছে। একটা নকল টয়লেট অব্দি বানানো আছে সিঁড়ির উপরে। তাতে টাওয়েল থেকে সব কিছু পরিপাটি করে রাখা। বিখ্যাত কিছু ক্রাইম এর দৃশ্য, শার্লকের হাফ গার্লফ্রেন্ড আইরিন আডলার, মরিয়ার্টি, শার্লকের বেহালা, সব রয়েছে। একজন বিশদে বলে বলে যাচ্ছে, কোনটার কী রেফারেন্স। এবং সেও কিন্তু আধুনিক পোশাকে না। বেচতেও জানতে হয়।  টুপিটার গল্প অব্দি বলছে। ভীড়টা কমে গেলে হুট করে মনে হতেই পারে, কোনো এক কালে সত্যিই হয়তো এখানে শার্লক আর জন থাকতো। 













বাইরে খুব বেশী খাবোনা ঠিক করেছিলাম, কিন্তু তাই বলেই একেবারে খাবোনা তাও তো না। খুঁজে খুঁজে একটা আশ্চর্য পাব খুঁজে পেয়েছিলাম যেখানে আনলিমিটেড কফি/চা/হট চকলেট মাত্র ১.১৯ পাউন্ডে। খুঁজে পেয়ে আমাদের সে কি আপশোষ , আগে কেন পাইনি তোমার দেখা টাইপ। কেন কে জানে , ওখানে এত সস্তা ছিল কফি , হয়তো বারে আমাদের মতো হাঁদাটে লোক ছাড়া কেউ কফি খেতে যায় না! এখানকার পাব কিন্তু বেশ জমকালো একটা জায়গা। একবার লন্ডনের একটা পুরোনো পাবে গিয়েছিলাম হিসি করতে। মানে রাস্তায় রাস্তায় সুলভ শৌচাগার নেই , তো সারাদিনের জন্যে বেরোই। হার্বিকে মনে আছে তো? হার্বিইই বলেছিল, যে কোনো পাবে ঢুকে যাবে , বিয়্যর খেলে লোকে হিসি তো করবেই , আর পাবে কে পান করছে আর কে টয়লেট সে নিয়ে অত কারোর মাথাব্যথা নেই। তো সেই পাবটায় ঢুকে মনে হচ্ছে আমি বুঝি দুশো বছরের পুরোনো কালে চলে গেছি , তুমুল হল্লাগুল্লা চলছে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় একাকার চারদিক। কেউ কারোর দিকে তাকিয়েও দেখছেনা। এই বড় বড় পিপে সাজানো আছে , যদিও মদটা ওর থেকে দিচ্ছে না। অবশ্য প্রাচীন কাল না, তা এক একটা টেবিল স্রেফ মেয়েদের দখলে আছে দেখে টের পাওয়া যায়। সৌরভ আসার পর একদিন যাওয়া হল এখানকার একটা পুরোনো পাবে। পকেটে রেস্তোঁ নেই বিশেষ। সত্যি বলতে খুব বেশী পাবে যাইনিও, বিদেশে বা দেশে। বিয়ারের ব্র‍্যান্ড চিনিনা, তেতো লাগে বলে হুইস্কিই প্রেফার করি, না হলে ভদকা। তা সন্ধ্যেবেলা বন্ধুবান্ধব সমেত ইংলিশ পাবে গিয়ে বিয়ার পান করার ব্যপারটাই বেশী আগ্রহ জাগিয়েছিল। হরেক রকম নল, ফ্রি টেস্ট করে সিলেক্ট করা যায় যে কোনো ব্র‍্যান্ড। সচরাচর ক্রাফট বিয়ার বেটার হয় গ্লিসারিন কম থাকে বলে। কিন্তু কী নেবো? ইংলিশ এল না ক্রাফট না সিডার? শেষে বার টেন্ডারের সহায়তা নিতে হল। তুমিই বলো ভাই। সে  এক দুটো টেস্ট করানোর পর একটু কনফিউজড। তার বুড়ো সহকর্মীকে বলছে এরা তো ফার্স্ট টাইম এল খেলো আর গিনেসও খায়নি। বুড়ো বলছে ফার্স্ট টাইম আহাহা, আই উইশ আই অ্যাম ইউ।
পাবে আবার এক মাতালের পাল্লায় পড়েছিলাম। সে আরেক গল্প।আমার গোঁফের খুব প্রশংসা করে, তারপর বলল  আমি কিন্তু মাতাল না। মাতাল চেনার উপায় হল এই ডায়লগটা। দেশে অল্পবয়সী ছেলে ছোকরারা যখন পিকনিক করে একটা দুটো ছেলে থাকবে, "ভাই আমি নিট মারবো, বলে খুব কেত নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে মাতাল হবে, তারপর বলবে, কে মাতাল, কোনো নেশা ফেশা হয়নি ভাই, আমি ঠিক আছি।এবং অবধারিত ভাবে বমি করে ছড়াবে বা বমি না করে ছড়াবে। এ মাতালটা তারপর তার ঝাঁপি খুলে বসেছে, ব্রাদার হ্যাভ কিড। আই হ্যাভ টু ওয়াইভস, থ্রি কিডস। হাউ মেনি ওয়াইভস ডু ইউ হ্যাভ? হোয়াই আর ইউ লাফিং, আই অ্যাম নট ড্রাংক।আমি বাংলায় বিড়বিড় করছি,  "ভালো মাতালের পাল্লায় পড়েছি"। বাকিরা হাসছে, মাতালের ভারী মানে লেগেছে। ব্রাদার, হোয়াই আর ইউ লাফিং আই অ্যাম নট লায়িং, সি দিস ইজ মাই ফার্স্ট ওয়াইফ,  দিস ইজ মাই সেকেন্ড। আই অ্যাম ফ্রম সোমালিয়া,  নো নো কেনিয়া অ্যাকচুয়ালি, ইউ নো,  আই অ্যাম ফ্রম হিয়ার অনলি। কোনো ক্রমে সে বিশ্বনাগরিকের থেকে ছাড় পেয়েছিলাম সেবার। 


(ক্রমশঃ)