Sunday, March 16, 2025

ফাগ আর ফাগুনের রাত

দোল চলে গেল পরশু। রঙ, হুল্লোড় হাহা হিহি। উৎসব বেশ লাগে। উৎসবের রঙও বদলে বদলে যায় কেমন। হাজার বছর আগে কেমন ছিল কে জানে! পাঁচশো বছর আগেই বা কেমন ছিল? হোলির বেশ অনেক্কটা দিন আগে থেকেই প্রকৃতি বেশ সাজতে শুরু করেছে। নিউটাউনের দিকে নানা রঙের ফুলের গাছ দেখা যায়। একেদিন,  কোনো ফাঁকা রাস্তায় নীচেটা ফুলে ভরে থাকে। অফিস থেকে ফেরার সময় সেদিন লুকিং গ্লাসে দেখি পিছনে ভেড়ির পারে লাল সূর্যটা ডুবছে, আকাশটা সিঁদুর রঙা। আশেপাশে গাছে ফুলের রঙ। আর তার একটু পরেই উইন্ডশিল্ডে উঁকিব্দিচ্ছে গোল্লা একটা চাঁদ। ক্যালেন্ডার না দেখেই জানতাম দোল চলেই এলো। এখন চারপাশেই মিশ্র জনজাতি। যে জাতি নিজের ইতিহাস মনে রাখতে চায়না তার ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ারই কথা।  ন্যাড়াপোড়া হয় না আর হোলিকাদহন হয়। তারপর শ্লোগান আসে হর হর মহাদেব। কারা যেন হাঁক দিত না, হর হর মহাদেব বলে? অবশ্য সে ভাবলে অনেক কিছুই ত্যাগ দিতে হয়। অত পারা যায় না। তা ছাড়া অতীতের ঘৃনা ভুলে যাওয়াই ভাল বটে। ভীড়ের মধ্যে মিশে দেখতে বেশ লাগে। ন্যাড়াপোড়াই হোক হোলিকাদহনই হোক। সত্যি বলতে উৎসবে হুল্লোড় করতে বন্ধু লাগে, জন লাগে। আমরা একটু স্বভাবে কুনো মতো। আমাদের বন্ধু কম, জন কম। তাই রঙের মেলায় পরস্পরকে রঙে চুবিয়ে পাড়া বেড়াই। আর তাতে মন্দ লাগে না। বিশেষ করে বাচ্ছাদের রঙ খেলা দেখতে।  ওই দেখো,  ধুতি পরে ফুলবাবুটি সেজে একজন চলেছে কেমন, রঙে ভিজে হাতাটা ন্যাপ্যাতে হয়ে গেছে বটে, কিন্তু নিজের পিচকারিটা দিয়ে রঙ দিয়ে আর ওঠা হচ্ছে না। ওদিকে আরেক খুকি  রঙে জলে আপাদমস্তক ভিজে ডানা মেলে  নেচে নেচে ঘুরছে, আর কোথা থেকে জোগাড় করে আনা নিমকি মুঠো ভরে মুখে তুলছে। এই পাড়ায় রবীন্দ্র সংগীতের সাথে নাচ, আবীর খেলা হচ্ছে, ভীড় কম। ওইদিকে ডিজে, ঠান্ডাই, রেন ড্যান্স, বিপুল ভীড়। মজার কথা, দুটো ভীড়েরই বাইরে থেকে দেখলে একটাই জিনিস, আনন্দ, হুল্লোড়। 
হাঁটতে হাঁটতে পিছনের রাস্তায় ঘুরে আসি, দোকান টোকান বন্ধ বেশীরভাগ। এদিকটায় মানুষও কম। খালি পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, হালকা গোলাপি ফুলের গাছগুলো রঙ মেখে দাঁড়িয়ে। বিকেল গড়ায়, হুল্লোড় থামে। সন্ধ্যেবেলা এই বড় গোল্লা একটা চাঁদ ওঠে। পড়েছি, বুদ্ধদেব নাকি এমনিই এ অনিত্য ভোগ বাসনার সংসারে উদাসীন ছিলেন, হোলি খেলার পর প্রমোদের চূড়ান্ত দেখে সিদ্ধান্ত আরো জলদি নেন (হ্যাঁ তখন শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গ কমই ছিল মানুষের,  সে এখনকার নাচা গানা যতই অপসংস্কৃতি বলে চালাও)। কিরকম ছিল সে রাত? এরকম কাক জ্যোৎস্নায়, কখনও কখনো মনে হয়, ডাইমেনশন বদলে যাবে, হুট করে হয়তো চলে যাব কোনো নদীর চরে, একা একা একটা লোক চলেছে, খুঁজতে....
কাল একটা পড়ে পাওয়া নেমতন্ন ছিল। রাতের বেলা, মাটন বিরিয়ানি, হালিম ইত্যাদি সেবা করে বাড়ি ফিরতে আর ইচ্ছে হয় না। ফুরফুরে হাওয়া,  জন ডেনভার, চাঁদের আলো সব মিলিয়ে মাতাল মাতাল লাগে। পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এ নেশা যন্ত্রে ধরা পড়েনা। একটা দুটো পানের দোকান, একটা দুটো গাড়ি, একটা দুটো লোক। ভেড়ির অন্যধারে নিয়ন আলো। নিয়ন আলো আর চাঁদের আলো যায়না। একটু সরে আসলে,  যেখানে নিয়ন আলো পৌঁছয়না,  চাঁদের আলোয় গাছ, জল সব কেমন অপার্থিব আদিম মতো হয়ে যায়। এক পূর্নিমাতেই কেন আরেকজনও ঘর ছেড়েছিলেন খানিক বোঝা যায় যেন কিংবা যায় না। বুকের মধ্যে কেমন আলগা হয়ে যায় যেন সব। দুর্দমনীয় একটা ইচ্ছে হয় এই রাস্তা ধরে আরো দূরে চলে যাওয়ার, চাঁদের আলোর সাথে...

Saturday, January 11, 2025

ধুলোবালি

হাঁটতে বেরিয়েছি একটু। সার্ভিস রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে কতকগুলো পিঁপড়ে চলেছে। দুজনের একজন আমার পায়ের কম্পনে মরার মতো পড়ে রইল মাথা গুঁজে, প্রার্থনা করছিল কিনা জানিনা। আরেকজন পাঁইপাঁই করে পালালো। আমার কাছে ওরা দুজনেই দৃশ্যমান। কাকে মারবো, কাকে বাঁচাবো, কাকে তাড়া করব আমি জানি বা জানিনা, কিন্তু যেটাই করব, সেটাই পরের প্রজন্মের পিঁপড়ের কাছে উদাহরণ হয়ে যাবে। ভূমিকম্পের সময় এরকম করতে হয়। প্রার্থনা বা দৌড়।ভগবান হওয়া খুব সোজা বেশ। ছায়া হয়ে দাঁড়ালাম তাদের যাবার পথটায়। বাড়ি ফিরে সে ছায়াদানকারীর জন্যে প্রার্থনা করবে, উপাসনা গৃহ বানাবে। মন্ত্র  তৈরী হবে। বেরোনোর আগে প্রার্থনা। ছায়াটুকু রেখো।ওর চোখে আমি দৃশ্যমান নই, ওর প্রার্থনা আমি শুনতেও পাইনা জানতেও পারিনা বুঝতেও পারিনা। ইনফ্যাক্ট আমি এতটুকু বিচলিতও নই। কিন্তু ও হয়তো আমায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ভাবছে। পিঁপড়ে আর মানুষের এই অবস্থানটা আমায় প্রায়ই ভাবায়। মানুষের থেকে এরকম বড় প্রাণী আছে আশেপাশে? যাকে দেখিনা, যার জীবনে আমার প্রভাব নেই কোনো অর্থেই, কিন্তু তার জন্যে আমরা লড়ে যাই?

 হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে পড়লাম, আশেপাশে লোকজন নেই। একটা পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ি আছে। মস্ত মস্ত জানালা। কে জানে কবে, কে কোন শখে বানিয়েছিল। কটা ঝোপঝাড়,  খেজুর গাছ।শান্ত একটা পুকুর। মস্ত পুকুর। দিঘী কিংবা ঝিল বলা যায়। অনেকদূরে কটা গরু আপনমনে ঘাস চিবুচ্ছে। জলের মধ্যে মাঝে মাঝে মাছ ঘাই দিচ্ছে। স্নিগ্ধ হাওয়ায় হেঁটে আসার পরিশ্রম দূর হয়। একটা দুটো বক উড়ে যায়। হলদে রঙের একটা ছোট্ট প্রজাপতি নাম না জানা ছোট্ট ছোট্ট গাছেদের উপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছ চিনিনা বলে, গুগল লেন্সে ফেলে ফেলে দেখছিলাম একটা একটা গাছ। সঠিক হয়তো না, কাছাকাছি কোনো গাছের ছবিই দিচ্ছে,  তা হলেও সব কটা গাছই ওষধই গাছ বলছে। অথচ এসব কেটেই,  সাফ করেই বসত উঠছে! আর কী গাছ লাগাচ্ছে,  না করবী! চরক সুশ্রুতের কত দিনের জ্ঞান এক লহমায় নেই করে দেয়। এমন বোকা পাঁঠারাও হয় কি?!

একটা শামুক পাতার উপর আরামে শুয়ে। লেজঝোলা, দোয়েল পাখি উড়ছে, বসছে। একটু দূরের বড় রাস্তা দিয়ে হুশ হুশ গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে,  পাশের রাস্তা ধরে খানিক গেলেই এমন আশ্চর্য ধনসামগ্রী, তার খোঁজ পায়নি। অবশ্য ধনদৌলত বস্তুটাই হাত ফিরলে এমন দাম বদল হয়, আদৌ তার অস্তিত্ব আছে কিনা সন্দ জাগে। যে লোকটা অসুস্থ হয়ে হাঁটতে পারেনা তার কাছে যেমন টাকার দামের থেকে সুস্থতার দাম বেশী, তেমনই আবার যে খেতে পায়না টাকার জন্যে, তার কাছে টাকার দাম খোলা হাওয়ার থেকে বেশী। কবে কোথায় যেন পড়েছিলাম, সত্য এক ও অনিত্য। তাই যদি হয়, তবে ধন মানেই দামী এ তো সত্যি হয় না। যা অনিত্য তা তা তো সত্য নয়। আবার সেই অনিত্যতায় কাউকে আকাশ দেখতে না দিয়ে বন্দী করে রাখলেই তার কাছে আকাশ দেখার মতো দামী কিছু না এ কথা মিথ্যে হয়ে যায় না! সত্যি আসলে আপেক্ষিক কিংবা মায়া!