দোল চলে গেল পরশু। রঙ, হুল্লোড় হাহা হিহি। উৎসব বেশ লাগে। উৎসবের রঙও বদলে বদলে যায় কেমন। হাজার বছর আগে কেমন ছিল কে জানে! পাঁচশো বছর আগেই বা কেমন ছিল? হোলির বেশ অনেক্কটা দিন আগে থেকেই প্রকৃতি বেশ সাজতে শুরু করেছে। নিউটাউনের দিকে নানা রঙের ফুলের গাছ দেখা যায়। একেদিন, কোনো ফাঁকা রাস্তায় নীচেটা ফুলে ভরে থাকে। অফিস থেকে ফেরার সময় সেদিন লুকিং গ্লাসে দেখি পিছনে ভেড়ির পারে লাল সূর্যটা ডুবছে, আকাশটা সিঁদুর রঙা। আশেপাশে গাছে ফুলের রঙ। আর তার একটু পরেই উইন্ডশিল্ডে উঁকিব্দিচ্ছে গোল্লা একটা চাঁদ। ক্যালেন্ডার না দেখেই জানতাম দোল চলেই এলো। এখন চারপাশেই মিশ্র জনজাতি। যে জাতি নিজের ইতিহাস মনে রাখতে চায়না তার ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ারই কথা। ন্যাড়াপোড়া হয় না আর হোলিকাদহন হয়। তারপর শ্লোগান আসে হর হর মহাদেব। কারা যেন হাঁক দিত না, হর হর মহাদেব বলে? অবশ্য সে ভাবলে অনেক কিছুই ত্যাগ দিতে হয়। অত পারা যায় না। তা ছাড়া অতীতের ঘৃনা ভুলে যাওয়াই ভাল বটে। ভীড়ের মধ্যে মিশে দেখতে বেশ লাগে। ন্যাড়াপোড়াই হোক হোলিকাদহনই হোক। সত্যি বলতে উৎসবে হুল্লোড় করতে বন্ধু লাগে, জন লাগে। আমরা একটু স্বভাবে কুনো মতো। আমাদের বন্ধু কম, জন কম। তাই রঙের মেলায় পরস্পরকে রঙে চুবিয়ে পাড়া বেড়াই। আর তাতে মন্দ লাগে না। বিশেষ করে বাচ্ছাদের রঙ খেলা দেখতে। ওই দেখো, ধুতি পরে ফুলবাবুটি সেজে একজন চলেছে কেমন, রঙে ভিজে হাতাটা ন্যাপ্যাতে হয়ে গেছে বটে, কিন্তু নিজের পিচকারিটা দিয়ে রঙ দিয়ে আর ওঠা হচ্ছে না। ওদিকে আরেক খুকি রঙে জলে আপাদমস্তক ভিজে ডানা মেলে নেচে নেচে ঘুরছে, আর কোথা থেকে জোগাড় করে আনা নিমকি মুঠো ভরে মুখে তুলছে। এই পাড়ায় রবীন্দ্র সংগীতের সাথে নাচ, আবীর খেলা হচ্ছে, ভীড় কম। ওইদিকে ডিজে, ঠান্ডাই, রেন ড্যান্স, বিপুল ভীড়। মজার কথা, দুটো ভীড়েরই বাইরে থেকে দেখলে একটাই জিনিস, আনন্দ, হুল্লোড়।
হাঁটতে হাঁটতে পিছনের রাস্তায় ঘুরে আসি, দোকান টোকান বন্ধ বেশীরভাগ। এদিকটায় মানুষও কম। খালি পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, হালকা গোলাপি ফুলের গাছগুলো রঙ মেখে দাঁড়িয়ে। বিকেল গড়ায়, হুল্লোড় থামে। সন্ধ্যেবেলা এই বড় গোল্লা একটা চাঁদ ওঠে। পড়েছি, বুদ্ধদেব নাকি এমনিই এ অনিত্য ভোগ বাসনার সংসারে উদাসীন ছিলেন, হোলি খেলার পর প্রমোদের চূড়ান্ত দেখে সিদ্ধান্ত আরো জলদি নেন (হ্যাঁ তখন শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গ কমই ছিল মানুষের, সে এখনকার নাচা গানা যতই অপসংস্কৃতি বলে চালাও)। কিরকম ছিল সে রাত? এরকম কাক জ্যোৎস্নায়, কখনও কখনো মনে হয়, ডাইমেনশন বদলে যাবে, হুট করে হয়তো চলে যাব কোনো নদীর চরে, একা একা একটা লোক চলেছে, খুঁজতে....
কাল একটা পড়ে পাওয়া নেমতন্ন ছিল। রাতের বেলা, মাটন বিরিয়ানি, হালিম ইত্যাদি সেবা করে বাড়ি ফিরতে আর ইচ্ছে হয় না। ফুরফুরে হাওয়া, জন ডেনভার, চাঁদের আলো সব মিলিয়ে মাতাল মাতাল লাগে। পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এ নেশা যন্ত্রে ধরা পড়েনা। একটা দুটো পানের দোকান, একটা দুটো গাড়ি, একটা দুটো লোক। ভেড়ির অন্যধারে নিয়ন আলো। নিয়ন আলো আর চাঁদের আলো যায়না। একটু সরে আসলে, যেখানে নিয়ন আলো পৌঁছয়না, চাঁদের আলোয় গাছ, জল সব কেমন অপার্থিব আদিম মতো হয়ে যায়। এক পূর্নিমাতেই কেন আরেকজনও ঘর ছেড়েছিলেন খানিক বোঝা যায় যেন কিংবা যায় না। বুকের মধ্যে কেমন আলগা হয়ে যায় যেন সব। দুর্দমনীয় একটা ইচ্ছে হয় এই রাস্তা ধরে আরো দূরে চলে যাওয়ার, চাঁদের আলোর সাথে...