এই শীত পড়ব পড়ব মুখটা অন্যরকম। পালাই পালাই আমার সারা বছরই লেগে থাকে, গরমের খাঁ খাঁ দুপুর হোক, বসন্তের উদাস হাওয়া হোক, শীতের আমেজ হোক কি বর্ষার ঘ্যানঘ্যান। এই যে সারাক্ষণ অস্থিরতা এ হয়তো মানসিক রোগ, কিন্তু অন্ধের দেশে কানা দশা আমার তাহলে। সব সুস্থ লোকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তা হেঁটে, গালাগালি করে, থুতু ফেলে ঘুষ দিয়ে সুস্থ থাকলে, এ অস্থিরতার মানসিক রোগী হয়েই বাঁচি। তো যা বলছিলাম, হেমন্তের সময়টা আরো আলাদা, পালাই পালাই এর সাথে নস্টালজিয়া এসে থাবা মারে। নস্টালজিয়া আমি নিজে যদিও খুব পছন্দ করি না। যা গেছে তাইই ভালো এ আমাদের স্বভাব, বরং আমি বর্তমানেই বেশী থাকি। কিন্তু হেমন্তের যে শীত আসছে হাওয়া, এ আমায় এলোমেলো করে দেয়। পুজো শেষ..কালীপুজো তারপরেই ভাইফোঁটা। আগে বেশ অপেক্ষা ছিল এ সময়টার। কিন্তু সন্ন্যাসী সাধকদের বোধহয় ওসব থাকতে নেই, তাই ভাইফোঁটা আসে তাদের আবার চলে যায়। গতবছর এই সময়টা কিন্নরে ছিলাম। ফিরে এসেছিলাম ভাইফোঁটার দিনই, দাদা (আমার দিদি, যাকে ছোটবেলায় জিভের লিমিটেশনের জন্যে দাদা বলতাম) চলে এসেছে, একগাদা রান্না করে। এবারে দাদা পালিয়ে গেলো কতদূর...
তবে, পালানো তো সোজা না, ডালের বড়া নরম না হলে মনে পড়ে আহা দাদা বানালে ভারী তুলতুলে হত, বাসের নাম দেখলে মনে হবে এই বাসের অপেক্ষার দিন আর দরকার নেই, এফ এমে বিজ্ঞাপন দেবে ভাইফোঁটার উপহার কিনুন...চ্যানেল বদলে দিলেও পালানো যায় না।
হেমন্তকালে বিদেশে ফল কালার দেখতে ছুটোছুটি পড়ে। দেখার মতোই জিনিস। এদেশেও পাতা ঝরে, রঙের তেমন জৌলুস নেই বলে চোখে পড়ে না। শীতের আগে পালালাম, হিমালয়ের কোলে। শেয়ার গাড়ি করে যাচ্ছি। ট্যুরিস্ট নেওয়া শেয়ার গাড়ি না, গ্রামের লোকেদের সার্ভিস গাড়ি। নির্দিষ্ট সময় যায় আসে গ্রাম থেকে শহরে। সে বেশ মজার গাড়ি, গ্রামের এক মুড়ো থেকে আরেক মুড়োয় কোনো জিনিস গেল, কিংবা জিনিস্পত্র নিয়ে এক গ্রাম থেকে মাঝ শহরের কোনো দোকানে। গাড়ি চলতে চলতে হাত নাড়ে বুড়ো বুড়ি, তরুনী, পরিচিতের হাসি। দিব্যি লাগে দেখতে। আমার তাড়া নেই। কোনো দশ বিশ পয়েন্টস দেখতে বেরোইনি রাস্তায়, মানুষ, গাছ, পাখি, পাহাড় এসব দেখতেই বেরিয়েছি। পাখি মানে আবার বার্ডার ভাবার দরকার নেই। বার্ডাররা খুব নাঁক উঁচু, কমন পাখিদের ওদের মনে ধরে না। ক্যামেরার লেন্স তাগ করে না তাদের। আমি তো বুলবুলি থেকে সবুজ রঙে কাজল পরা ছোট্ট পাখি সব হাঁ করে দেখি। একেকটা পাখি কেমন ছোট! ফার্ণের ডালেও দোল খায়! এক জায়গায় অবশ্য থাকা হয় না আমার, প্রায় রোজই একেকটা নতুন গ্রাম, নতুন মানুষ। ব্যাকপ্যাকার ট্রাভেলার হওয়ার সুবিধে হল, প্যাকিং এ সময়ও যায় না।
এক গ্রামের এক বাড়িতে আছি সে রাতে। জঙ্গলে মধ্যেই একটা পাহাড়ের মাথায় বাড়িটা। সামনে ফাঁকা, কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জটাই সকালে দেখা যায়, বেলায় জঙ্গলের রাস্তা ধরে হাঁটি, চারপাশে ঘরবাড়ি নেই তেমন। অনেকটা নীচে একটা দুটো ফার্ম স্টে, বা হোমস্টে। একটা দুটো গ্রামের বাড়ি, দোকান। আপাতত জঙ্গুলে হাওয়া, পোকার ডাক, পাখির ডাক আর নিজেদের জুতোর আওয়াজ ছাড়া আওয়াজ নেই। ওহো না দূর থেকে ছোট্ট জলপ্রপাতটার আওয়াজ আসছে বটে। রাস্তা বলতে যা আছে তা বিশেষ সুবিধের না। পাথুরে গাছহীন অংশ বলা যায় বড়জোর। এদিক সেদিক থেকে ছ্যট ছোট ঝর্ণা গুলো মাঝে মাঝেই রাস্তার উপর দিয়ে বইছে। তাদের আলাদা জায়গা করে দেওয়া আছে বটে, এক পাশ দিয়ে যাবার জন্যে, কিন্তু কিছু জলের স্বভাব ছক ভাঙার, তারা রাস্তা দিয়ে বয়ে তারপর খাদে পড়বে৷ প্রপাতটার কাছ অব্দি পৌঁছতে অনেকটা পাহাড় নামতে হয় বটে, কিন্তু পৌঁছলে একরাশ গুঁড়ো গুঁড়ো জলকণা সারা শরীর জুড়িয়েও দেয়।
যেখানে আছি আজ, সেটা পাহাড়ে উপর জঙ্গলের গায়ে। একদিকে পাইনের জঙ্গল, আরেকদিকে চোখ মেললে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিনোলচু ইত্যাদি পাহাড়চুড়ো, আরেকদিকে অন্য পাহাড়। বেশ কিছুটা দূরে দূরে, ছড়ানো ছিটানো, গোটা পাঁচেক কাঠের কটেজ। লগ হাট প্যাটার্ণের ঘর গুলোর ভিতরে পরিচ্ছন পর্দা দিয়ে ঢাকা খান পাঁচেক জানালা, কাচের, সেখানে চোখ রাখলেও দিব্যি আকাশ, গাছ, পাহাড় । আপাতত শুধু আমরা দুজনই একটা কটেজে আছি, বাকি সব ফাঁকা। সামনের বারান্দায় বসলে চোখে পড়বে শায়িত বুদ্ধের প্রতিমূর্তির মতো হিমালয়ের পুরো রেঞ্জটা। বুদ্ধের পা শেষ হবার পরের কিছু পাহাড়ের চূড়াও দেখা যায়। প্রতিটা চুড়ারই নাম আছে, পড়েছি, আবার ভুলেও গেছি। শেষ সূর্যের আলোয় মেঘ, বরফ রাঙিয়ে দেওয়ার সময় চূড়ার নাম নিয়ে আর কে ভাবে! ডানদিকের পাহাড়ে মেঘের ছায়া পড়ে গাছপালার উপর। মাঝে মাঝে দূর থেকে শিশুদের খেলার আওয়াজ, কিংবা অন্য কোনো জায়গা থেকে গানের আওয়াজ ক্ষীন ভাবে ভেসে আসে।
সন্ধ্যে নামলে পাহাড়ে একটা দুটো করে আলো ফুটে ওঠে। তারপর হঠাৎ করে লোডশেডিং। পরিস্থিতিটা বেশ মন্দ না। এতখানি চত্বরে স্রেফ আমরা দুজন। অনেকটা দূরে রান্নাঘরের কাছে, কেয়ারটেকারের ঘরে, স্ত্রী পুত্র সহ কেয়ারটেকার ছেলেটি আছে বটে, তবে শ্রবণ ও দৃষ্টিসীমার বেশ বাইরে। ওহো এই ভরা অমাবস্যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে সবই আসলে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাইরে বেরোতে চমক লাগে, আকাশে অজস্র তারায় দীপাবলি পালিত হচ্ছে যেন। চারদিক অন্ধকার বলে দেখতে আরো সুবিধে হচ্ছে। চোখ সইতে দেখি আকাশগঙ্গার একটা অংশ। খুব স্পষ্ট না, লাদাখের মতো, কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায় বটে। এরকম একটা অবাস্তব অলৌকের মধ্যে দাঁড়ালে কেমন যেন লাগে। চারদিক অন্ধকার পাহাড়, সামনে সাদা কটেজের পিছনেই দুটো পাইন গাছ, এক আকাশ তারা আর আকাশগঙ্গার যাত্রাপথের নীচে দাঁড়িয়ে আছি দুজন। এ অনন্ত সম্ভারের নীচে দাঁড়িয়ে আলোর উদযাপনের দিনই বটে৷
আরেকদিন, সেদিন অন্য একটা গ্রামে। আর কোনো ট্যুরিস্ট সে গ্রামে সেদিন ছিল না। চেয়ারে বসে সামনে তাকিয়ে শায়িত বুদ্ধ দেখো, বুদ্ধের পা ছাড়িয়ে অন্য একটা বরফ চূড়ো, সেটা কোন চুড়ো সেটা নিয়ে ভাবো, এই তোমার কাজ৷ ছাগলের ম্যা ম্যা ছাড়া আর আওয়াজ নেই কোনো। হাওয়ার আওয়াজ আছে, মাঝে মধ্যে জঙ্গুলে পোকা ওই অব্দি৷ পাহাড়ের এদিকটায় আগে আসিনি, এদিকের গাছ পালা গুলো একটু অন্যরকম। পাহাড়ের ঢাল গুলো খানিক চওড়া, চাষ বাস হয়েছে। সেদিন ছিল দেওয়ালীর পরের দিন, দুপুরের দিকে এক অন্ধ ভদ্রলোক, তার দুই নাতিকে নিয়ে এদের বাড়ি সৌভাগ্যের গান শোনাতে এসেছিল। তোমাদের ক্ষেতি বাড়ি, তোমাদের হোমস্টে, এই পরিবার ইত্যাদি সবার যশ বৃদ্ধি হোক। একটা কাঁসার থালায় চাল, স্কোয়াশ আর একশো টাকা ধরে দিলেন, এ পরিবারের সব চেয়ে বয়স্কা, যাকে ঠাকুমা বলে ডাকছি। দুপুরে আমাদের সাথে গল্প করছিলেন, কেমন তার দূর দেশ (দার্জিলিং এর কাছে) থেকে বিয়ে হয়েছে এইখানে। তখনকার দিনে, অনেকটা বড় বিপত্নীক এক লোকের ঘর করতে এসেছিলেন তিনি। গল্প শোনাচ্ছিলেন তাঁর নাতির, তাঁর রাজহাঁসের।
শহর ছেড়ে বেরিয়ে এসব গাছ, অকিঞ্চিকর বিষয়ের গল্প, পাহাড়ি ঝর্ণা, অকুলীন পাখি, গাছ আমার অস্থিরতা কমিয়ে দেয়। কখনো হাঁটি, কখনো চুপ করে বসে নিস্তব্ধতা শুনি...বুকের মধ্যে হেমন্তের বিষন্নতা কমে যায়। শান্ত হয়ে যায় সব। জলের উপর পাতলা সরের মতোই বরফ যেন সে পালানে জলের স্রোতে সাময়িক স্থিতি দেয়। আমি শহরে ফিরি, নীল আকাশ ঘোলা হয়ে যায়,বরফের স্তর গলা শুরু হয়ে যায়....