আজকেই অস্ট্রিয়ার শেষ দিন। আজ বিকেলে ট্রেন ধরে চলে যাব প্রাগ। সকালে ময়ূরাক্ষীর কিছু কাজ ছিল। সেসব সেরে, ঝটপট ব্রেকফাস্ট সেরে আর চমৎকার একটা কফি শেষ করে তিন মূর্তি বেরোলাম। মৌসুমীর অফিস আছে। সুদীপ ছুটি নিয়েছে আমাদের জন্যে৷ আজ বেশী দূরে কোথাও না, কাছেই প্রাটারে যাব। সে এক মস্ত পার্ক। পার্ক মানে, নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের দ্বিগুন প্রায়। একদিকে প্রচুর এন্টারটেইনমেন্ট এর জিনিস, অন্য দিকে প্রচুর সবুজ। সবুজ মানে সে প্রায় হারিয়ে যাবার মতো ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়ি চলছে মস্ত মস্ত গাছপালার ফাঁকে। ঘোড়াও চলে, লোকে ছুটছে, হাঁটছে। আবার কোথাও কোথাও জঙ্গল এত ঘন, হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা (মানে বাঘ ভালুক না খেলেও গাদা হাঁটতে হবে সঠিক রাস্তায় আসতে, কিংবা পোকামাকড় তো রইলোই)। নিজেদের মতো হাঁটছি, গল্প করছি, থামছি। এক সময় নদীর ধারে চলে এলাম। দানিয়ূব এখানে সরু, কিন্তু বড় সুন্দর। নীল আকাশ, তার রঙে দানিয়ুবও নীল। দূরে একটা উইন্ডমিল, নদীর আরেক পারে একটা প্যাগোডা। পার ধরে সবুজ ঘাস, একটা দুটো বোটহাউস। নদীর ঘাটে বসে আছি তিনজনে। দেখ দেখ কী তিনটে রাজহাঁস নদীতে। ও বাবা এদিকে আসছে তো। বেশ হাসিহাসি মুখে বসে আছি তাকিয়ে। রাজহাঁস দেখতে ভারী সুন্দর তো বটেই, আর যেমন সাবলীল ভঙ্গীতে সাঁতার কাটে দেখলেও ভাল্লাগে। আরে এদিকেই আসছে দেখছি। ও বাবা এ যে এসে একেবারে চমকাচ্ছে,,তেড়ে এলো যে। ভঙ্গীটা 'এইয়ো আমার ঘাটে তোরা কে রে বসে!?" পাঁই পাঁই করে উঠে পালাতে হল!! ইওরোপে গিয়ে রেসিজম এর শিকার হলাম রাজহাঁসের থেকে! এ দু:খ রাখি কোথায়! অপমানিত রাজ্যপাল হয়ে উঠে চলে আসি।
মনের দু:খ ভুলতে মদ কতটা কাজ করে জানিনা, খাবার দাবার খুব করে৷ ঘাসে থেবড়ে বসি, ঝোলা থেকে বেরোয় আমাদের সামান্য আয়োজন। কলা পাঁউরুটি এটা সেটায় আমাদের পিকনিক হয়। আনন্দ আসলে মানসিক স্থিতি, তার সাথে আমরা বহু জিনিস জড়িয়ে ফেলি, খালি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস বাদে, প্রকৃতি। একই লোক, পাহাড়ের বাঁকে, সমুদ্রের ধারে বালিতে, ঘাসের সবুজে যেমন মানসিক অবস্থায় থাকবে, সে কি হর্ন, কংক্রিটের জঙ্গলে একইরকম ভালো থাকবে! থাকা সম্ভব!
বিকেল হয়, আমাদের ভিয়েনা ছাড়ার সময় চলে আসে। মৌসুমীও জলদি চলে এসেছে অফিস থেকে। সুদীপ মৌসুমীদের কাছে বেশ কাটলো।বিদায় ব্যপারটা সর্বদাই একটু চিনচিনে হয়..
বাসের খাবার উল্টোদিকের টার্কিশ দোকান থেকে প্যাক করিয়ে নিয়েছি৷ সুদীপ সি অফ করতে বাস স্ট্যান্ড অব্দি এলো। বাস স্ট্যান্ড নামেই, কেতা তো সেইই টাইপ। ঢুকলে মনে হবে, এয়ারপোর্টে ঢুকছি।পশ্চিমা দেশ গুলো এসব ব্যপারে এতটা এগিয়ে গেছে, খালি মনে দু:খ হয়, ইসস আমাদের দেশেও এসব করাই যেত, টাকাও ছিল.....যাকগে। ভিয়েনা থেকে বাসে চলেছি প্রাগ। বিদেশে এই সস্তার বাসগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে বলা যায়। এর আগেরবার, লন্ডন থেকে এডিনব্রা যেতেও এই বাস ভরসা ছিল, ময়ূরাক্ষী বুদাপেস্ট থেকে ব্রাতিস্লাভা গেল সেও এও বাসেই। আবার আমরা প্রাগ থেকে বুদাপেস্টও যাব। দিব্যি আরামদায়ক, সস্তার বাস। সময়জ্ঞান চমৎকার। একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে যাওয়া ইওরোপে এতই মসৃন, দেশের গন্ডী আছে বলেই মনে হয়না। একটা টোলবুথও না পেরিয়ে, স্রেফ ম্যাপ থেকে বুঝলাম, অস্ট্রিয়া থেকে চেক রিপাবলিক ঢুকেছি। চেক বললেই, ছোটবেলায় বইতে পড়া, চেকশ্লোভাকিয়া মনে হয় খালি। কিন্তু চেক আর শ্লোভাকিয়া আলাদা হয়ে হয়ে গেছে বেশ অনেকদিন হল। এদের ভাষায় হ্যাপ্পিলি ডিভোর্সড। কোনো রক্তাক্ষয়ী সংগ্রাম না, বিবাদ না, স্রেফ "তুমিও ভালো, আমিও ভালো, তবে আলাদা থাকা আরো ভালো" টাইপ। বাস থেকে যতটুকু দেখা যায় তাতে দেশটা কিঞ্চিৎ গরীব বলে বোধ হয়,। মানে অস্ট্রিয়ার আর চেকের বাড়ি ঘরের তফাৎ বেশ চোখে পড়ে। রঙ অনেক মলিন, কিছু তো পলেস্তারা খসে পড়েছে। বাড়ি গুলো দেখেও মনে হয় বেশ পুরোনো, আর একটু কমদামীই। মাঝখানে এক জায়গায় বাস থেমেছিল খাবার রেস্ট এসবের জন্যে। সে রেস্তোরাঁটা বেশ ঝকঝকে, ড্রাইভার সাহেব আর তার খালাসি খুবখানিক মাংস, ঝোল, সবজি নিয়ে বসলেন দেখলাম। আমরা আমাদের দুড়ুম মানে ওই টার্কিশ রোল খেয়ে নিয়েছি আগেই। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত, ঠান্ডাও পড়ছে। দিনের এই সময়টা মনে হয় সূর্য যেন পাঁই পাঁই করে ছোটে। সারাদিনের কাজের পর বাড়ি ফেরার তাড়া।
প্রাগে নামলাম তখন দশটা। শেষের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম না ভাঙলে হয়তো ডিপোয় চলে যেতাম। কেউ তো ডেকে দেয় না এখানে, "প্রাগ পএসে গেছে উঠে পড়ুন" বলে। নেমে ভারী ভালো অভিজ্ঞতা হল। আমাদের কার্ডটা ট্যাপ এনাবল করা নেই, টিকিট কাটার মেশিন এদিকে ট্যাপ ছাড়া নেয় না। ক্যাশ একমাত্র চেক করুণা নেয়। আমাদের কাছে আছে ইউরো। টিকিট অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে আমার ফোনের টাচ কাজ করছে না বলে ট্যাপ এনাবল করতে পারছিনা। এমন অবস্থায়, দুটি ছেলে মেয়ে নিজে থেকে এগিয়ে এসে নানান ভাবে চেষ্টা করল, যাতে কার্ডটা কাজ করে। শেষে বলল, এক কাজ করো বাসে করে যাও, ওখানে অপশন থাকে ট্যাপ এনাবল কার্ড না হলেও টিকিট কাটার। এমনকি নিজের থেকে টিকিট কেটে দেবেও বলছিল। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই খুবই বিব্রত, না না, আমরা দেখছি বললাম। তারপরেও অনেক চেষ্টা করেও হচ্ছেনা, আরেকজন ভদ্রমহিলা, মেশিনে করে সাফাই করছিলেন, স্টেশন চত্বরটা। ও হ্যাঁ স্টেশনটা মারাত্মক। মানে বিশাল একটা বহুতল বিল্ডিং, বিভিন্ন দিকের মেট্রো ছাড়ছে, দোকান পাতি আছে এ ইওরোপের সব জায়গাতেই, তবে এটা বেশ দেখতে।যাওহোক, ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে বুঝেছেন কিছু একটা গোলমালে পড়েছি, এবং আমরা স্থানীয় না। নিজে থেকে থেমে বুঝলেন সমস্যা। ইংরেজি ভাষা বোঝেন না, আমরাও চেক ভাষা জানিনা। আকারে ইঙ্গিতেই হল কথা। তারপর আরেকপাক ঘুরে এসে, নিজে কয়েন দিয়ে দিয়ে আমাদের তিরিশ মিনিটের টিকিট কেটে দিলেন দুটো।
আমি নিজে এ কাজ করতাম কিনা জানিনা। হয়তো গরীব দেশ, মানে প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া বা জার্মানির তুলনায়, মনটা গরীব না। বড় ভালো লাগলো অজানা ভাষার এক দেশে নেমে এমন আপ্যায়ন পেয়ে।
ট্রেন থেকে নেমে তো খুব কনফিউজড, কোন দিকে গেলে যে বাস স্ট্যান্ড পাবো কে জানে! বাস ধরে আমাদের হস্টেলে যেতে হবে। কিঞ্চিৎ দূর আছে। রাত হলেও বাস চলে, তাই সেই চিন্তা নেই, তাও রাতও অনেকটা হয়েছে। গুগল ম্যাপে যা দেখাচ্ছে তা খুবই একটা সরু গলিপথ, অন্ধকার মতো। এমনিই ইওরোপীয়ান শহর গুলো রাতের বেলা ভুতুম মতো হয়ে যায়। রাস্তা ফাঁকা, দোকানপাট ঝাঁপ ফেলে দেয়। তায় প্রাগের এই অংশটা খুবই ফাঁকা ফাঁকা, কিছ্য মাতাল হেঁটে যাচ্ছে। নতুন দেশে, ভাষা বুঝি না দুই উজবুক এদিক ওদিক দেখতে দেখতে শেষে এক মাতালকেই জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এই বাস স্ট্যান্ডটা কোথায়? মাতাল হলেও তালে ঠিক আছে। সঠিকই বলে দিল। কিন্তু ময়ূরাক্ষী মানবে কেন, আমি মাতালকে রাস্তা জিজ্ঞেস করেছি কেন সে নিয়ে খুব ইয়ে করল। যাকগে, গুগল ম্যাপ আর মাতাল মিলে যে সরু মতো রাস্তা দেখাচ্ছে তাতেই যাই। অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তার কাছে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ও দাদা এই বাস স্ট্যান্ডটা কোথায়? সেও ওখানেই যাবে, আমাদের প্রায় সঙ্গে করেই নিয়ে গেল। বাস একটু কমে এসেছে রাত হয়েছে মেলা। যদিও বাস স্ট্যান্ডে অনেক লক দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের হস্টেলের লোকেশনে বাস থেকে নেমেছি, টিমটিমে হলুদ আলো জ্বলা বাস স্টপ। নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, কোন দিক দিয়ে হস্টেলটা ইত্যাদি। একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা তিনিও বাস থেকে নামলেন, এগিয়ে এসে বললেন, হ্যাঁ এটাই রাস্তা, ওইদিক দিয়ে যাও। আমি এমনিতেও গুগল ম্যাপের থেকে মানুষের কথায় বেশী নিশ্চিত হই, মালপত্র নিয়ে এগোই। ও বাবা দু কদম যেতে না যেতেই, আরেক ভদ্রলোক আমাদের ম্যাপ দেখতে দেখে, প্রায় পৌঁছেই দিলেন হস্টেল অব্দি। প্রাগের লোকেরা বড় ভালো। প্রাগ প্রথম দিনেই হৃদয় জিতে নিয়েছে। এত রাতেও দলে দলে অল্পবয়সী ছেলে পুলেরা চলেছে রাস্তা দিয়ে ওই হস্টেলের দিকেই। হস্টেলের লাউঞ্জেও প্রচুর লোক। এই হস্টেলটা বাচ্ছা নিয়েও থাকা যায়। সই সাবুদ করে এগোতে যাব, বলে কিনা ওহে চাদর দিয়ে যবে না? অ্যাঁ? হস্টেল মানে একেবারে চাদর পেতে নেওয়া হস্টেল! এবার কি মশারিও টাঙাতে বলবে নাকি রে বাবা! সকালে হয়তো ঘন্টাবাজার সাথে উঠে প্রেয়ার করে পড়তেও বসতে বলবে! নাহ সেসব নয়, দেখে চাদর, সুটকেস, লটবহর নিয়ে চললাম নিজেদের ঘরের দিকে...






