সলজবার্গের ট্রেন ছিল অনেকটা সকালে। ঝটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুজন। গুগল ম্যাপ কেন জানি একটু ঘোল খাওয়ায় মাঝে মাঝে। তাড়াহুড়ো করে স্টেশনে ঢুকে প্ল্যাটফর্মে যেতে গিয়ে সে এক ঝামেলা। তা আমরা দুজন একটু হাবা মতো বলে মেনে নিয়েছি, তাই এইসব আমাদের সঙ্গী হবেই সেও জানা। তাও মনে তো দু:খ হয়ই, "এত ছড়ু কেন আমরা"। সেই সব নিয়েই সলজবার্গে পৌঁছলাম৷ সলজবার্গে ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন থেকে কার্ড কেনার সময়, সেন্টারের মেয়েটিই বলল, খরচ কম করতে চাইলে সালজবার্গ কার্ড কিনে নাও আর তারপর বাসে করে লেক সাইডে যাও আলাদা করে। তাতে খরচ কম হবে তোমাদের। তাই করা হল।শুরু হল আমাদের দৌড়াদৌড়ি। আজ দিনটাই আছি খালি। আমাদের ইচ্ছে আছে মোজার্টের বাড়ি, সলজবার্গ দুর্গ টুর্গ দেখে চলে যাব শহরের বাইরে। সলজবার্গ মানে সাউন্ড অফ মিউজিক এর দেশ। পাহাড় লেক ঘেরা সেসব জায়গা ঘুরে শহরে ফিরে রাতের ট্রেন ধরব। হাতে সময় কম বলে মিউজিয়ামে হালকা ঢুঁ মেরেই বেরিয়ে আসব ইচ্ছে ছিল। ও বাবা এখানকার মিউজিয়ামের লোকেরা ভারী ভালোবাসে নিজেদের কাজকর্ম৷ "আরে এটা দেখবে না, সেকি! অন্তত ওইটুকুটা দেখো।" এরকম বলে বলে প্রায় পুরো মিউজিয়ামই ঘুরে ফেললাম।
মিউজিয়ামটা হেব্বি বানিয়ে রেখেছে। লাল কার্পেট পাতা, এই চওড়া সিঁড়ি। যেন অস্কার নিতে চলে পিঠে বোঁচকা নিয়ে। বড় এত আন্তরিক ভাবে ভালোবেসে দেখাচ্ছিল, আমাদেরও সত্যি বলতে ভালোই লাগছিল৷ মিউজিয়ামটা একদম শহরের মাঝে, ছিল কোনো রাজার বাড়ি। ছাদে বসে কেরম প্রেমসে পাহাড় দেখতে দেখতে চা খেত!! ওহোহো, রাজা হলেই ভালো হত রে। অবশ্য খুব কথা বলত চারপাশ থেকে লোকে, আর রাজ্যের হাবিজাবি শুনে যেতে হত। বেস্ট হত রাজার সেই ছেলে যার সিংহাসন পাওয়ার আশা নেই, কিন্তু খাতিরদারি ষোলো আনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পাশের ঘরে যাই, এখান থেকে চ্যাপেলটার চমৎকার একটা ব্যালকনি ভিউ পাওয়া যায়। এদের কী যেন একটা প্যারাডাইস লস্ট শো চলছে, সেটায় যাবার ইচ্ছে ছিল না তেমন কারণ আমরা দুজনেই আঁকায় যাকে বলে পিকাসোর প্রেত। আমি না দেখে গরু ছাগল আঁকলে এমন বিকট জন্তু হয়, বাচ্ছারা তো ছাড়, বড়রাই আঁতকে ওঠে। তাছাড়া সময়েও কম। কিন্তু ওই, কর্মচারীদের ঠেলায় ঢুকেই পড়েছি। বেশ চমৎকার সব ছবি। ন্যাংটো অ্যাডাম ইভ আপেল খেয়ে ফস করে পৃথিবীতে এসে জামা কাপড় পড়ে ফেলার থেকেও আশ্চর্য হলুম, ওদের ওরকম জনহীন পৃথিবীতে মসৃন লাল সিল্ক দিল কে?
মিউজিয়াম ঘুরে, পাহাড়ে চড়ে কেল্লা দেখতে চলেছি। সেই পাহাড়ে চড়ার ট্রেন বা ট্রাম। দুর্গের পুরোটা ট্রেন ওঠায় না, খানিক বাদেই স্বর্গের সিঁড়ির মতো অনন্ত সিঁড়ি বাইতে হয়। হোমলেসদের যেমন পিঠেই সংসার থাকে, আমাদের দুজনের পিঠেও সেরকম মস্ত ঝোলা থাকে সারাক্ষণ। তাতে ওষুধের বোঁচকা (যা দেখলে লোকে ভাববে এরা বেঁচে আছে কেন? কিন্তু খুবই দরকারি জিনিস। এ জিনিসটা বাদ দেওয়া যায় না), জলের বোতল, ছাতা আর গাধার মতো অজস্র সোয়েটার ভরা৷ কেন কে জানে অত সোয়েটার ভরার আগে একবার আবহাওয়া কিরকম হতে পারে দেখিনি! ওহো কে জানে কেন কি, ওই যে ছড়ু তাই। জিভ বার করে হাঁফাতে হাঁফাতে চুড়োয় উঠলাম। উঁচু থেকে শহরটা দেখতে বেশ লাগছে, ছোট শহর। শহরের মধ্যে দিয়েই সলজ নদী বয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা ব্রিজ এপাড় ওপাড়ের জন্য। সকালে যখন ট্রেন স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়েছি, বাস স্ট্যান্ডে এদিক ওদিক খুঁজছি, কেমন করে ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার যাব, এক আফগান আমাদের দেখে এগিয়ে এসে সাহায্য করলো। কোন জায়গায় দাঁড়ালে বাস পাবো দেখিয়ে দিয়ে গেল। এইটা আমি আগেও খেয়াল করেছি, বিদেশে এলে, পাকিস্তান বলো আফগানিস্তান বলো, একই জায়গার লোক বলেই ভাবে। ঝগড়াঝাঁটি করার জন্যে দেশটা এতোই দূর, দেশের লোক তখন গন্ডী মানে না৷
হাঁটতে হাঁটতে গেলুম মোজার্টের বাড়ি। মানে জন্মস্থান আর কি৷ ভদ্রলোক খুব ঘুরতেন তো! তেমনই খরুচে লোক দেখছি! ধার করে করে আলা হয়ে গেছিল একেবারে! আরিব্বাস এইটাই সেই পিয়ানো, যাতে বসে আশ্চর্য সব সুর তৈরী করতেন! অবশ্য পিয়ানো দিয়ে কী হবে আর, মাথাই হল আসল। আমি এই পিয়ানোয় বসলে সুর বেরোবে বটে, তবে গাধার সুর।
সলজবার্গের আসল মজা হল তার লেক,পাহাড়৷ সময় কম তাই বলেই একটু সে স্বাদ চেখে দেখবো না তাই কি হয়। সুতরাং সওয়ার হলাম বাসে। এই বাসটা শহর থেকে বাইরে যায়৷ খেয়াল হল এক ফোঁটা জলও নেই সঙ্গে। যে ভদ্রমহিলা বাস চালাচ্ছিলেন, তাকে কাঁচুমাচু করে বললাম রাস্তায় কোথায় জল পাবো? বাসে পাওয়ার উপায় আছে? আফ্রিকান বংশদ্ভূত সে মহিলা তো ভারী দু:খী হলেন শুনে, হাঁকপাঁক করলেন, "আমার কাছে একদম জল নেই আজ, তোমায় দিতাম তাহলে, আমাদের তো এর মাঝে কোথাও এমন দাঁড়াবে না যে জল কেনার সময় পাবে। তবে আমরা যেখানে পৌঁছবো সেখানেই গ্যাস স্টেশনে পাবে। আমি খুবই দুঃখিত, কিন্তু সত্যিই আমার কাছে জল নেই। " অগত্যা, আর কি করা। এদিকে চারপাশের চেহারা বদলে গেছে। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, তার পারে পাহাড়। মাঝে মাঝে এক দুটো বাড়ি। তেষ্টা পেয়েছে, জল নেই সে নিয়ে দু:খ পেয়ে বসে থাকলেও তেষ্টা কমবে না, উলটে চারপাশের এমন মনোরম দৃশ্যও ধরতে পাবো না। কষ্টের কথা ভুলে চেয়ে রইলাম বাইরে। বাস থেকে নেমে এগিয়ে চললাম লেকের দিকে। পাহাড় দিয়ে ঘেরা মন্ডসি লেকের সামনে তখন প্রচুর লোক। ছুটির দিন পেয়ে সকলেই চলে এসেছে। লেকের ধারে গাছের ছায়ায় বসে আছে প্রচুর বাচ্চা আর প্রচুর খাবারদাবার সমেত টার্কিশ পরিবার, কোথাও আছে বুড়ো দম্পতি। টুকটুক করে হেঁটে চলেছে অতি বৃদ্ধ আর প্যারামবুলেটরে করে দাঁত না গজানো শিশু। খাবার দাবারের দোকানে ভীড়, বেশির ভাগই লাইন দিয়েছে আইসক্রিমের জন্যে। আমরাও দিলাম। অনেক অনেকক্ষণ সেই জল, গাছ, ঘাস আর প্রাণের মাঝে রইলাম।
ফেরার বাসে উঠে টের পেলাম খিদে পেয়েছে বেশ। ভালো কিন্তু সস্তা খাবার দোকান মানেই তুর্কদেশীয় খাবার। একটা জায়গা আছে, শহরের মধ্যেই কিন্তু ট্যুরিস্ট প্লেস থেকে দূরে, অনেকগুলো দোকান। আমাদের কার্ড আছে তাই সমস্যা নেই। বাস বদলে বদলে চললাম সে জায়গায়। তারপর দোকান বেছেবুছে বসে পড়া গেল, কাবাব প্ল্যাটার নিয়ে। এটা আমাদের দেশের চৌকো চৌকো কাবাবের মতো না। সোওয়ারমা থেকে অনেকখানি মাংস নেওয়া হয়, আর প্রচুর স্যালাড, ওদের একটা মিক্সড সস ইত্যাদি সাথে পাঁউরুটি বা ভাত।
বিকেলের আলো এখনো শেষ হয়নি, আমাদের সালজবুর্গ কার্ডে একটা ক্রুজের কথা আছে, কিন্তু গুগলে দেখাচ্ছে বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা তো হতাশ, এ বাবা, আগেই যাওয়াই যেত। ঠিক আছে তাও যাওয়াই যাক না ওখানে। এমনিও আমরা নদীর ধারেই যেতামই। গিয়ে দেখি, লাস্ট ক্রুজ বাকি তখনো। তাড়াতাড়ি গিয়ে টিকিট কালেক্ট করা হল। কাউন্টারের ভদ্রলোক বারবার জানালেন, আজ জল কম আছে তাই আধঘন্টা কম ক্রুজ হবে। তারপর যখন ক্রুজে উঠলাম তখনো ক্যাপ্টেন (বেশ দেখতে ছিল ভদ্রমহিলাকে) বারবার দু:খ প্রকাশ করে জানালেন, নদীতে জল কমে যায় বিকেলের দিকে, আজ বেশীই কমে গেছে, নাব্যতা কম তাই আমরা বেশীদূর গেলে আটকে যাব। আমাদের দেশের সাথে তুলনা করে ফেলছি বারবার, কিন্তু তাও মনে পড়েই যায় চট করে, বিভিন্ন ট্যুরিস্ট প্লেসে, এরকম নৌকা ইত্যাদি নিলে, কেমন গা জোয়ারি চলে। এক ঘন্টা মানে কোনো সময়েই এক ঘন্টা করায় না, সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে! দুর্নীতি বিষয়টা আসলে, যতক্ষণ নিজেকে এফেক্ট না করে আমরা মনে করি যা করছি সব জাস্টিফায়েড। আমাদের দেশে এ রোগ যাওয়া শক্ত আছে।
ক্রুজে করে বেশ চারপাশ দেখতে দেখতে চলেছি, কনে দেখা আলো পড়েছে দুপাশে, পাথরের বাড়ি, প্যালেস, গাছ সব সোনার হয়ে গেছে। দ্রষ্টব্য তো হরেক, তার বৃত্তান্তও ক্যাপ্টেন বলছেন, আমি শুনছি বটে তার ভাঙা ভাঙা সালজবার্গ এর ইংরেজি, কিন্তু আসলে চেয়ে আছি চারপাশের এই অদ্ভুত সুন্দরে৷ নামার আগে ভদ্রমহিলা আমাদের ক্রুজটা দুপার পাক খাওয়ালেন জলে, সে বেশ মজার। নদীর ধারে, ব্রিজের উপর ভায়োলিন বাজাচ্ছে একজন, সেই সোনা ঝরা আলোয় সুরের মূর্ছনায় চারপাশটা অদ্ভুত মায়াবী হয়ে গেছে। ব্রিজের উপর তালা ঝুলিয়ে নিজেদের সম্পর্ককে স্বায়ীত্ব দিতে চেয়েছে কতজনায়। তারা আজও বেঁচে আছে কিনা কে জানে! কিংবা তাদের সম্পর্ক হয়ত অন্য কারোর সাথে, কিংবা তালার জোরেই তাদের সম্পর্কও জুড়ে আছে জানিনা, খালি তালাগুলো রয়ে গেছে তাদেরভসেই মুহুর্তগুলোর স্মৃতি নিয়ে। সম্পর্ক থাক বা থাক, মুহুর্তটা তো আর মিথ্যে ছিল না। চিরস্থায়ী কিইই বা হয় এই ব্রহ্মান্ডে!
পাথরের সিংহের মুখ থেকে জল ভরছিলাম আমরা। খুব সরু হয়ে পড়ছিল, হয়তো আমাদের মতো গরীব ট্যুরিস্ট ছাড়া তেমন কেউ আর আসে না। তা আমাদের পাশেই দুটি মেয়ে বসেছিল, রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যাওয়ার সময়, দুটি ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখে ওদের ডায়লেক্টে জার্মান ভাষায় কিছু বলল, সম্ভবতঃ কিছু প্রস্তাব। মেয়ে দুটি হাসতে হাসতে জবাব দিল, যে মেয়েটির তুলনায় ছেলেটি বেশীই বুড়ো। তাতে ছেলেটিও হেসেই চলে গেল। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়ায় পুরোটা হল। একজন প্রস্তাব দিল, অন্যজন সে প্রস্তাবে অরাজী হল, সেটুকু সম্মান দিয়ে প্রস্তাবকারী চলে গেল। এমনটাই হওয়া উচিত ছিল না কি সর্বত্র? ঘোমটায়, বোরখায়, কোরানে পুরানে ব্যপারটা আমরা এত জটিল করে ফেলেছি কেন!?
ফিরতি পথে সুদীপদের সাথে ট্রেনে মোলাকাত হল। একসাথে চললাম ফিরে। বাড়ি ফিরে চাট্টি ভাতে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়া হবে ঠিক হয়েছে। কিন্তু বলছিলাম না এই ছেলে মেয়ে দুটো খুবই ভদ্রলোক। বলেছিলাম একবার কথায় কথায়, স্নিটজেল আরেকবার খেলে হত তা সুদীপ দেখি সব মনে রেখেছে। অত রাতেও সে আমাদের স্নিটজেল ধরে দিয়েছে পাতে। পৃথিবীতে এত ভালোবাসায় যত্নে বেঁচে থাকি সেসব মনে না রেখে স্রেফ অভিযোগেই দিন কাটিয়ে দিই। এই রাতে নরম উষ্ণ বিছানা, পছন্দের গরম খাবার,বন্ধুদের ঘিরে থাকা আর , কর্মঠ সুস্থ শরীর...এর পরেও জীবনকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যায় কি?














