Friday, January 3, 2025

চক্র

সকালের রোদটা উঠব উঠব করছে, লাইব্রেরি বিল্ডিং এর ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে, বেরোনোর আগে। নেড়িটা তড়াক করে লাফ দিয়ে ওঠে একটা, নাহ আর তো খিদেটা চেপে থাকা যাচ্ছেনা! রোদ দেখা যাচ্ছে, ঠান্ডাটা এবার কম লাগবে, ওঠাই যাক। বাচ্ছা হয়েছে এক পাল কদিন আগেই। কটা মরেছে, কটা বেঁচেছে,কটা লায়েক হয়ে গেল। দুটো এখনো দুধ খুঁজে বেড়ায়। ছাড়াও যায়না,  এদিকে ওগুলোকে দিতে দিতে পাঁজরাগুলো বেরিয়ে এসেছে, পেটটা গেছে ঝুলে। নিম গাছের ডালে কাঠবিড়ালিটাও বেরিয়ে পড়েছে, খাবার কিছু আছে কিনা খুঁজতে। নেড়িটা অলস চোখে একবার তাকায়, নাহ ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, দেখা যাক কাল রাতের এঁটোকাঁটা কিছু ফেলল কিনা কেউ। পায়ে পায়ে এগোয় সে, উত্তাপের খোঁজে, খাবারের খোঁজে। 

রক্ত আর গরম নেই, গরম খুঁজতে হয় আলাদা করে। নীমগাছের নীচে রোদটা এলেই বুড়ি মানুষটা টুল নিয়ে টুকটুক করে গিয়ে বসে। সকাল মানে ব্যস্ত সময়, ছোট ছানাটা স্কুলে যাবে, বাপ মা যাবে কলেজে পড়াতে। এই প্রবল কর্মযজ্ঞে তার আর কিছু দেবার নেই, স্রেফ ওই সকালের রোদ্দুরটাই সত্যি। এক ঘন্টা, দু ঘন্টা,  তিন ঘন্টা...। এ প্রায় সন্ন্যাসীর মতোই জীবন না? এইভবে একা একা চুপ করে বসে থাকা! কী ভাবেন উনি? মাথা ঝুঁকিয়ে মাটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে? এই বৃদ্ধার হাসিতে এখনো ঔজ্জ্বল্য আছে। 
একটা সাইকেলে সমস্ত সবজি নিয়ে অতি আশ্চর্য ব্যালান্স নিয়ে আসে সবজি বিক্রেতা। তার পিছু পিছুই প্রায় আসে মাছওয়ালা। রোদ নিমগাছের গোড়া থেকে সরে যায়। নীচটা ফাঁকা এখন। স্কুল থেকে বাচ্ছা ছেলে মেয়ে দুটো ফেরে। ফিরেই লাফাতে থাকে। প্রাণশক্তি তাদের বিস্তর, স্ফূর্তিতে ভরপুর। চিন্তাহীন। এও এক রকম সন্ন্যাসীর জীবন কি? 

তারপরেই একেকদিন আসে হনুমানেএ দল। আশ্চর্য খুশীতে, দক্ষতায় দোল খেতে খেতে লাফায় ছোট গুলো। লেজ ঝুলিয়ে একমনে গম্ভীর মুখে বিসে থাকে গোদাগুলো। তেঁতুল পাতা খায় বিরস মুখে। জানলায় এসে উঁকি মেরে দেখে কারোর ঘর থেকে কিছু ছিনতাই করা চলে কিনা। হনুমান হবার শখ আমার সেই কবে থেকে। কাজ ফেলে হাঁ করে দেখি, উফফ কি চমৎকার লাফ দিলো, কী চমৎকার একখানা লেজ,  আহাহা। রোদ ওঠে আরো উপরে, ঘুরতে ঘুরতে পূব দিক থেকে পশ্চিমের দিকে যায়। চারটে বুলবুলি কোথা থেকে যেন ঘুরতে ঘুরতে এ পাড়ায় এসে বসে। টুইটুই করে কী বলে বুঝিনা। গাছেদের কথা, পাখিদের কথা শিখতে পারিনি এখনো আমরা। লোভের কথা, রাগের কথা, ক্ষমতার কথা শিখেছি কেবল। সেদিন পন্ডিত রবিশঙ্করের একটা ইন্টারভিউ দেখছিলাম। আমার সুরজ্ঞান নেই, তালজ্ঞানও নেই। ছন্দ, রাগ বুঝিনা। আমিও দিব্যি সেতারের ভাষা বুঝতে পারছিলাম। স্রেফ কথার কথা না, সত্যিই সুরের একটা ঝর্ণা বয়ে গেল,  নেয়ে উঠে দেখলাম আলো আলো। বারান্দায় এসে দাঁড়াই। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি রোগা মা কুকুরটা করুণ চোখে তাকিয়ে বসে। বাচ্ছাটাকে দেখতে ভালো, তাই আশপাশের লোকে খেতে দেয়, একে দেখতে ভালো না খেতেও পায়না। এ চেঁচামেচি করেনা।কিছু মিছু ছুঁড়ে দিই। এ চেঁচামেচি না করলেও ওইদিকে আরেক মক্কেল আছে সে খুবই বদ। বাচ্ছাগুলোকেও শিখিয়ে রেখেছে, "মানুষ গেলেই তাক করে চলে যাবি, ভয় দেখাবি"।  ওটাকে কিচ্ছু দিইনা। দুপুর গড়ায়, ছাতারেদের ক্যাচোরম্যাচোর বাড়ে।

উপরের সবই গত বছরের গল্প। এ বছরেও তাইই থাকবে। সমান্তরাল জীবন বইবে, এক এক রকম ভাবে। কেউ রোদের খোঁজে, কেউ খাবারের খোঁজে, কেউ বিরস মুখে, কেউ আনন্দের খোঁজে এ বছরটাও কাটাবে।  খোঁজ চলুক, খোঁজ মিলুক।