Sunday, October 26, 2025

হেমন্তের পাহাড়ে

এই শীত পড়ব পড়ব মুখটা অন্যরকম। পালাই পালাই আমার সারা বছরই লেগে থাকে, গরমের খাঁ খাঁ দুপুর হোক, বসন্তের উদাস হাওয়া হোক, শীতের আমেজ হোক কি বর্ষার ঘ্যানঘ্যান। এই যে সারাক্ষণ অস্থিরতা এ হয়তো মানসিক রোগ, কিন্তু অন্ধের দেশে কানা দশা আমার তাহলে। সব সুস্থ লোকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তা হেঁটে, গালাগালি করে,  থুতু ফেলে ঘুষ দিয়ে সুস্থ থাকলে,  এ অস্থিরতার মানসিক রোগী হয়েই বাঁচি। তো যা বলছিলাম, হেমন্তের সময়টা আরো আলাদা, পালাই পালাই এর সাথে নস্টালজিয়া এসে থাবা মারে। নস্টালজিয়া আমি নিজে যদিও খুব পছন্দ করি না। যা গেছে তাইই ভালো এ আমাদের স্বভাব, বরং আমি বর্তমানেই বেশী থাকি। কিন্তু হেমন্তের যে শীত আসছে হাওয়া, এ আমায় এলোমেলো করে দেয়। পুজো শেষ..কালীপুজো তারপরেই ভাইফোঁটা। আগে বেশ অপেক্ষা ছিল এ সময়টার। কিন্তু সন্ন্যাসী সাধকদের বোধহয় ওসব থাকতে নেই, তাই ভাইফোঁটা আসে তাদের আবার চলে যায়। গতবছর এই সময়টা কিন্নরে ছিলাম। ফিরে এসেছিলাম ভাইফোঁটার দিনই, দাদা (আমার দিদি, যাকে ছোটবেলায় জিভের লিমিটেশনের জন্যে দাদা বলতাম) চলে এসেছে, একগাদা রান্না করে। এবারে দাদা পালিয়ে গেলো কতদূর...
তবে, পালানো তো সোজা না, ডালের বড়া নরম না হলে মনে পড়ে আহা দাদা বানালে ভারী তুলতুলে হত, বাসের নাম দেখলে মনে হবে এই বাসের অপেক্ষার দিন আর দরকার নেই, এফ এমে বিজ্ঞাপন দেবে ভাইফোঁটার উপহার কিনুন...চ্যানেল বদলে দিলেও পালানো যায় না।

হেমন্তকালে বিদেশে ফল কালার দেখতে ছুটোছুটি পড়ে। দেখার মতোই জিনিস। এদেশেও পাতা ঝরে, রঙের তেমন জৌলুস নেই বলে চোখে পড়ে না। শীতের আগে পালালাম, হিমালয়ের কোলে। শেয়ার গাড়ি করে যাচ্ছি। ট্যুরিস্ট নেওয়া শেয়ার গাড়ি না, গ্রামের লোকেদের সার্ভিস গাড়ি। নির্দিষ্ট সময় যায় আসে গ্রাম থেকে শহরে। সে বেশ মজার গাড়ি, গ্রামের এক মুড়ো থেকে আরেক মুড়োয় কোনো জিনিস গেল, কিংবা জিনিস্পত্র নিয়ে এক গ্রাম থেকে মাঝ শহরের কোনো দোকানে। গাড়ি চলতে চলতে হাত নাড়ে বুড়ো বুড়ি, তরুনী, পরিচিতের হাসি। দিব্যি লাগে দেখতে। আমার তাড়া নেই। কোনো দশ বিশ পয়েন্টস দেখতে বেরোইনি রাস্তায়, মানুষ, গাছ, পাখি,  পাহাড় এসব দেখতেই বেরিয়েছি। পাখি মানে আবার বার্ডার ভাবার দরকার নেই। বার্ডাররা খুব নাঁক উঁচু, কমন পাখিদের ওদের মনে ধরে না। ক্যামেরার লেন্স তাগ করে না তাদের। আমি তো বুলবুলি থেকে সবুজ রঙে কাজল পরা ছোট্ট পাখি সব হাঁ করে দেখি। একেকটা পাখি কেমন ছোট! ফার্ণের ডালেও দোল খায়! এক জায়গায় অবশ্য থাকা হয় না আমার, প্রায় রোজই একেকটা নতুন গ্রাম, নতুন মানুষ। ব্যাকপ্যাকার ট্রাভেলার হওয়ার সুবিধে হল, প্যাকিং এ সময়ও যায় না। 

এক গ্রামের এক বাড়িতে আছি সে রাতে। জঙ্গলে মধ্যেই একটা পাহাড়ের মাথায় বাড়িটা। সামনে ফাঁকা, কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জটাই  সকালে দেখা যায়, বেলায় জঙ্গলের রাস্তা ধরে হাঁটি, চারপাশে ঘরবাড়ি নেই তেমন। অনেকটা নীচে একটা দুটো ফার্ম স্টে, বা হোমস্টে।  একটা দুটো গ্রামের বাড়ি, দোকান। আপাতত জঙ্গুলে হাওয়া,  পোকার ডাক, পাখির ডাক আর নিজেদের জুতোর আওয়াজ ছাড়া আওয়াজ নেই। ওহো না দূর থেকে ছোট্ট জলপ্রপাতটার আওয়াজ আসছে বটে। রাস্তা বলতে যা আছে তা বিশেষ সুবিধের না। পাথুরে গাছহীন অংশ বলা যায় বড়জোর। এদিক সেদিক থেকে ছ্যট ছোট ঝর্ণা গুলো মাঝে মাঝেই রাস্তার উপর দিয়ে বইছে। তাদের আলাদা জায়গা করে দেওয়া আছে বটে, এক পাশ দিয়ে যাবার জন্যে, কিন্তু কিছু জলের স্বভাব ছক ভাঙার, তারা রাস্তা দিয়ে বয়ে তারপর খাদে পড়বে৷ প্রপাতটার কাছ অব্দি পৌঁছতে অনেকটা পাহাড় নামতে হয় বটে, কিন্তু পৌঁছলে একরাশ গুঁড়ো গুঁড়ো জলকণা সারা শরীর জুড়িয়েও দেয়।


যেখানে আছি আজ, সেটা পাহাড়ে উপর জঙ্গলের গায়ে। একদিকে পাইনের জঙ্গল, আরেকদিকে চোখ মেললে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিনোলচু ইত্যাদি পাহাড়চুড়ো,  আরেকদিকে অন্য পাহাড়। বেশ কিছুটা দূরে দূরে, ছড়ানো ছিটানো, গোটা পাঁচেক কাঠের কটেজ। লগ হাট প্যাটার্ণের ঘর গুলোর ভিতরে পরিচ্ছন পর্দা দিয়ে ঢাকা খান পাঁচেক জানালা, কাচের, সেখানে চোখ রাখলেও দিব্যি আকাশ, গাছ, পাহাড় । আপাতত শুধু আমরা দুজনই একটা কটেজে আছি, বাকি সব ফাঁকা। সামনের বারান্দায় বসলে চোখে পড়বে শায়িত বুদ্ধের প্রতিমূর্তির মতো হিমালয়ের পুরো রেঞ্জটা। বুদ্ধের পা শেষ হবার পরের কিছু পাহাড়ের চূড়াও দেখা যায়। প্রতিটা চুড়ারই নাম আছে, পড়েছি, আবার ভুলেও গেছি। শেষ সূর্যের আলোয় মেঘ, বরফ রাঙিয়ে দেওয়ার সময় চূড়ার নাম নিয়ে আর কে ভাবে! ডানদিকের পাহাড়ে মেঘের ছায়া পড়ে গাছপালার উপর। মাঝে মাঝে দূর থেকে শিশুদের খেলার আওয়াজ, কিংবা অন্য কোনো জায়গা থেকে গানের আওয়াজ ক্ষীন ভাবে ভেসে আসে। 
সন্ধ্যে নামলে পাহাড়ে একটা দুটো করে আলো ফুটে ওঠে। তারপর হঠাৎ করে লোডশেডিং।  পরিস্থিতিটা বেশ মন্দ না। এতখানি চত্বরে স্রেফ আমরা দুজন। অনেকটা দূরে রান্নাঘরের কাছে, কেয়ারটেকারের ঘরে,  স্ত্রী পুত্র সহ কেয়ারটেকার ছেলেটি আছে বটে, তবে শ্রবণ ও দৃষ্টিসীমার বেশ বাইরে। ওহো এই ভরা অমাবস্যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে  সবই আসলে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাইরে বেরোতে চমক লাগে, আকাশে অজস্র তারায় দীপাবলি পালিত হচ্ছে যেন। চারদিক অন্ধকার বলে দেখতে আরো সুবিধে হচ্ছে। চোখ সইতে দেখি আকাশগঙ্গার একটা অংশ। খুব স্পষ্ট না, লাদাখের মতো, কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায় বটে। এরকম একটা অবাস্তব অলৌকের মধ্যে দাঁড়ালে কেমন যেন লাগে। চারদিক অন্ধকার পাহাড়, সামনে সাদা কটেজের পিছনেই দুটো পাইন গাছ, এক আকাশ তারা আর আকাশগঙ্গার যাত্রাপথের নীচে দাঁড়িয়ে আছি দুজন। এ অনন্ত সম্ভারের নীচে দাঁড়িয়ে আলোর উদযাপনের দিনই বটে৷

আরেকদিন, সেদিন অন্য একটা গ্রামে। আর কোনো ট্যুরিস্ট সে গ্রামে সেদিন ছিল না। চেয়ারে বসে সামনে তাকিয়ে শায়িত বুদ্ধ দেখো, বুদ্ধের পা ছাড়িয়ে অন্য একটা বরফ চূড়ো, সেটা কোন চুড়ো সেটা নিয়ে ভাবো, এই তোমার কাজ৷  ছাগলের ম্যা ম্যা ছাড়া আর আওয়াজ নেই কোনো। হাওয়ার আওয়াজ আছে, মাঝে মধ্যে জঙ্গুলে পোকা ওই অব্দি৷ পাহাড়ের এদিকটায় আগে আসিনি, এদিকের গাছ পালা গুলো একটু অন্যরকম। পাহাড়ের ঢাল গুলো খানিক চওড়া, চাষ বাস হয়েছে। সেদিন ছিল দেওয়ালীর পরের দিন, দুপুরের দিকে এক অন্ধ ভদ্রলোক, তার দুই নাতিকে নিয়ে এদের বাড়ি সৌভাগ্যের গান শোনাতে এসেছিল। তোমাদের ক্ষেতি বাড়ি, তোমাদের হোমস্টে,  এই পরিবার ইত্যাদি সবার যশ বৃদ্ধি হোক। একটা কাঁসার থালায় চাল, স্কোয়াশ আর একশো টাকা ধরে দিলেন, এ পরিবারের সব চেয়ে বয়স্কা,  যাকে ঠাকুমা বলে ডাকছি। দুপুরে আমাদের সাথে গল্প করছিলেন, কেমন তার দূর দেশ (দার্জিলিং এর কাছে) থেকে বিয়ে হয়েছে এইখানে। তখনকার দিনে,  অনেকটা বড় বিপত্নীক  এক লোকের ঘর করতে এসেছিলেন তিনি। গল্প শোনাচ্ছিলেন তাঁর নাতির, তাঁর রাজহাঁসের। 

শহর ছেড়ে বেরিয়ে এসব গাছ, অকিঞ্চিকর বিষয়ের গল্প, পাহাড়ি ঝর্ণা, অকুলীন পাখি, গাছ আমার অস্থিরতা কমিয়ে দেয়। কখনো হাঁটি, কখনো চুপ করে বসে নিস্তব্ধতা শুনি...বুকের মধ্যে হেমন্তের বিষন্নতা কমে যায়। শান্ত হয়ে যায় সব। জলের উপর পাতলা সরের মতোই বরফ যেন সে পালানে জলের স্রোতে সাময়িক স্থিতি দেয়। আমি শহরে ফিরি, নীল আকাশ ঘোলা হয়ে যায়,বরফের স্তর গলা শুরু হয়ে যায়....

Wednesday, August 13, 2025

ইওরোপে কটাদিন (ভিয়েনায় আর প্রাগে)

আজকেই অস্ট্রিয়ার শেষ দিন। আজ বিকেলে ট্রেন ধরে চলে যাব প্রাগ। সকালে ময়ূরাক্ষীর কিছু কাজ ছিল। সেসব সেরে, ঝটপট ব্রেকফাস্ট সেরে আর চমৎকার একটা কফি শেষ করে তিন মূর্তি বেরোলাম। মৌসুমীর অফিস আছে। সুদীপ ছুটি নিয়েছে আমাদের জন্যে৷ আজ বেশী দূরে কোথাও না, কাছেই প্রাটারে যাব। সে এক মস্ত পার্ক। পার্ক মানে, নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের দ্বিগুন প্রায়। একদিকে প্রচুর এন্টারটেইনমেন্ট এর জিনিস, অন্য দিকে প্রচুর সবুজ। সবুজ মানে সে প্রায় হারিয়ে যাবার মতো ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়ি চলছে মস্ত মস্ত গাছপালার ফাঁকে। ঘোড়াও চলে, লোকে ছুটছে, হাঁটছে। আবার কোথাও কোথাও জঙ্গল এত ঘন, হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা  (মানে বাঘ ভালুক না খেলেও গাদা হাঁটতে হবে সঠিক রাস্তায় আসতে, কিংবা পোকামাকড় তো রইলোই)।  নিজেদের মতো হাঁটছি, গল্প করছি, থামছি। এক সময় নদীর ধারে চলে এলাম। দানিয়ূব এখানে সরু, কিন্তু বড় সুন্দর। নীল আকাশ, তার রঙে দানিয়ুবও নীল। দূরে একটা উইন্ডমিল, নদীর আরেক পারে একটা প্যাগোডা। পার ধরে সবুজ ঘাস, একটা দুটো বোটহাউস। নদীর ঘাটে বসে আছি তিনজনে। দেখ দেখ কী তিনটে রাজহাঁস নদীতে। ও বাবা এদিকে আসছে তো। বেশ হাসিহাসি মুখে বসে আছি তাকিয়ে। রাজহাঁস দেখতে ভারী সুন্দর তো বটেই, আর যেমন সাবলীল ভঙ্গীতে সাঁতার কাটে দেখলেও ভাল্লাগে। আরে এদিকেই আসছে দেখছি। ও বাবা এ যে এসে একেবারে চমকাচ্ছে,,তেড়ে এলো যে। ভঙ্গীটা 'এইয়ো আমার ঘাটে তোরা কে রে বসে!?" পাঁই পাঁই করে উঠে পালাতে হল!! ইওরোপে গিয়ে রেসিজম এর শিকার হলাম রাজহাঁসের থেকে! এ দু:খ রাখি কোথায়! অপমানিত রাজ্যপাল হয়ে উঠে চলে আসি।







 মনের দু:খ ভুলতে মদ কতটা কাজ করে জানিনা, খাবার দাবার খুব করে৷   ঘাসে থেবড়ে বসি, ঝোলা থেকে বেরোয় আমাদের সামান্য আয়োজন। কলা পাঁউরুটি এটা সেটায় আমাদের পিকনিক হয়। আনন্দ আসলে মানসিক স্থিতি, তার সাথে আমরা বহু জিনিস জড়িয়ে ফেলি, খালি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস বাদে, প্রকৃতি। একই লোক, পাহাড়ের বাঁকে, সমুদ্রের ধারে বালিতে, ঘাসের সবুজে যেমন মানসিক অবস্থায় থাকবে, সে কি হর্ন, কংক্রিটের জঙ্গলে একইরকম ভালো থাকবে! থাকা সম্ভব!  


বিকেল হয়, আমাদের ভিয়েনা ছাড়ার সময় চলে আসে।  মৌসুমীও জলদি চলে এসেছে অফিস থেকে। সুদীপ মৌসুমীদের কাছে বেশ কাটলো।বিদায় ব্যপারটা সর্বদাই একটু চিনচিনে হয়..
বাসের খাবার উল্টোদিকের টার্কিশ দোকান থেকে প্যাক করিয়ে নিয়েছি৷ সুদীপ সি অফ করতে বাস স্ট্যান্ড অব্দি এলো।  বাস স্ট্যান্ড নামেই, কেতা তো সেইই টাইপ। ঢুকলে মনে হবে,  এয়ারপোর্টে ঢুকছি।পশ্চিমা দেশ গুলো এসব ব্যপারে এতটা এগিয়ে গেছে, খালি মনে দু:খ হয়, ইসস আমাদের দেশেও এসব করাই যেত,  টাকাও ছিল.....যাকগে। ভিয়েনা থেকে বাসে চলেছি প্রাগ। বিদেশে এই সস্তার বাসগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে বলা যায়। এর আগেরবার, লন্ডন থেকে এডিনব্রা যেতেও এই বাস ভরসা ছিল, ময়ূরাক্ষী বুদাপেস্ট থেকে ব্রাতিস্লাভা গেল সেও এও বাসেই। আবার আমরা প্রাগ থেকে বুদাপেস্টও যাব। দিব্যি আরামদায়ক, সস্তার বাস। সময়জ্ঞান চমৎকার। একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে যাওয়া ইওরোপে এতই মসৃন, দেশের গন্ডী আছে বলেই মনে হয়না। একটা টোলবুথও না পেরিয়ে, স্রেফ ম্যাপ থেকে বুঝলাম, অস্ট্রিয়া থেকে চেক রিপাবলিক ঢুকেছি। চেক বললেই,  ছোটবেলায় বইতে পড়া, চেকশ্লোভাকিয়া মনে হয় খালি। কিন্তু চেক আর শ্লোভাকিয়া আলাদা হয়ে হয়ে গেছে বেশ অনেকদিন হল। এদের ভাষায় হ্যাপ্পিলি ডিভোর্সড। কোনো রক্তাক্ষয়ী সংগ্রাম না, বিবাদ না, স্রেফ "তুমিও ভালো, আমিও ভালো,  তবে আলাদা থাকা আরো ভালো" টাইপ।  বাস থেকে যতটুকু দেখা যায় তাতে দেশটা কিঞ্চিৎ গরীব বলে বোধ হয়,।  মানে অস্ট্রিয়ার আর চেকের বাড়ি ঘরের তফাৎ বেশ চোখে পড়ে। রঙ অনেক মলিন, কিছু তো পলেস্তারা খসে পড়েছে। বাড়ি গুলো দেখেও মনে হয় বেশ পুরোনো, আর একটু কমদামীই। মাঝখানে এক জায়গায় বাস থেমেছিল খাবার রেস্ট এসবের জন্যে। সে রেস্তোরাঁটা বেশ ঝকঝকে, ড্রাইভার সাহেব আর তার খালাসি খুবখানিক মাংস, ঝোল, সবজি নিয়ে বসলেন দেখলাম। আমরা আমাদের দুড়ুম মানে ওই টার্কিশ রোল খেয়ে নিয়েছি আগেই। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত, ঠান্ডাও পড়ছে। দিনের এই সময়টা মনে হয় সূর্য যেন পাঁই পাঁই করে ছোটে। সারাদিনের কাজের পর বাড়ি ফেরার তাড়া। 



প্রাগে নামলাম তখন দশটা। শেষের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম না ভাঙলে হয়তো ডিপোয় চলে যেতাম। কেউ তো ডেকে দেয় না এখানে, "প্রাগ পএসে গেছে উঠে পড়ুন" বলে। নেমে ভারী ভালো অভিজ্ঞতা হল। আমাদের কার্ডটা  ট্যাপ এনাবল করা নেই, টিকিট কাটার মেশিন এদিকে ট্যাপ ছাড়া নেয় না। ক্যাশ একমাত্র চেক করুণা নেয়। আমাদের কাছে আছে ইউরো। টিকিট অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে আমার ফোনের টাচ কাজ করছে না বলে ট্যাপ এনাবল করতে পারছিনা। এমন অবস্থায়, দুটি ছেলে মেয়ে নিজে থেকে এগিয়ে এসে নানান ভাবে চেষ্টা করল, যাতে কার্ডটা কাজ করে। শেষে বলল, এক কাজ করো বাসে করে যাও, ওখানে অপশন থাকে ট্যাপ এনাবল কার্ড না হলেও টিকিট কাটার। এমনকি নিজের থেকে টিকিট কেটে দেবেও বলছিল। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই খুবই বিব্রত,  না না,  আমরা দেখছি বললাম। তারপরেও অনেক চেষ্টা করেও হচ্ছেনা, আরেকজন ভদ্রমহিলা, মেশিনে করে সাফাই করছিলেন, স্টেশন চত্বরটা। ও হ্যাঁ স্টেশনটা মারাত্মক। মানে বিশাল একটা বহুতল বিল্ডিং, বিভিন্ন দিকের মেট্রো ছাড়ছে, দোকান পাতি আছে এ ইওরোপের সব জায়গাতেই, তবে এটা বেশ দেখতে।যাওহোক, ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে বুঝেছেন কিছু একটা গোলমালে পড়েছি, এবং আমরা স্থানীয় না। নিজে থেকে থেমে বুঝলেন সমস্যা। ইংরেজি  ভাষা বোঝেন না, আমরাও চেক ভাষা জানিনা। আকারে ইঙ্গিতেই হল কথা। তারপর আরেকপাক ঘুরে এসে, নিজে কয়েন দিয়ে দিয়ে আমাদের তিরিশ মিনিটের টিকিট কেটে দিলেন দুটো।
আমি নিজে এ কাজ করতাম কিনা জানিনা। হয়তো গরীব দেশ, মানে প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া বা জার্মানির তুলনায়, মনটা গরীব না। বড় ভালো লাগলো অজানা ভাষার এক দেশে নেমে এমন আপ্যায়ন পেয়ে। 
ট্রেন থেকে নেমে তো খুব কনফিউজড,  কোন দিকে গেলে যে বাস স্ট্যান্ড পাবো কে জানে! বাস ধরে আমাদের হস্টেলে যেতে হবে। কিঞ্চিৎ দূর আছে। রাত হলেও বাস চলে, তাই সেই চিন্তা নেই,  তাও রাতও অনেকটা হয়েছে।  গুগল ম্যাপে যা দেখাচ্ছে তা খুবই একটা সরু গলিপথ, অন্ধকার মতো। এমনিই ইওরোপীয়ান শহর গুলো রাতের বেলা ভুতুম মতো হয়ে যায়। রাস্তা ফাঁকা, দোকানপাট ঝাঁপ ফেলে দেয়। তায় প্রাগের এই অংশটা খুবই ফাঁকা ফাঁকা, কিছ্য মাতাল হেঁটে যাচ্ছে। নতুন দেশে, ভাষা বুঝি না দুই উজবুক এদিক ওদিক দেখতে দেখতে শেষে এক মাতালকেই জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এই বাস স্ট্যান্ডটা কোথায়? মাতাল হলেও তালে ঠিক আছে। সঠিকই বলে দিল। কিন্তু ময়ূরাক্ষী মানবে কেন, আমি মাতালকে রাস্তা জিজ্ঞেস করেছি কেন সে নিয়ে খুব ইয়ে করল। যাকগে, গুগল ম্যাপ আর মাতাল মিলে যে সরু মতো রাস্তা দেখাচ্ছে তাতেই যাই। অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তার কাছে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ও দাদা এই বাস স্ট্যান্ডটা কোথায়? সেও ওখানেই যাবে, আমাদের প্রায় সঙ্গে করেই নিয়ে গেল। বাস একটু কমে এসেছে রাত হয়েছে মেলা। যদিও বাস স্ট্যান্ডে অনেক লক দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের হস্টেলের লোকেশনে বাস থেকে নেমেছি, টিমটিমে হলুদ আলো জ্বলা বাস স্টপ। নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, কোন দিক দিয়ে হস্টেলটা ইত্যাদি।  একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা  তিনিও বাস থেকে নামলেন, এগিয়ে এসে বললেন, হ্যাঁ এটাই রাস্তা, ওইদিক দিয়ে যাও। আমি এমনিতেও গুগল ম্যাপের থেকে মানুষের কথায় বেশী নিশ্চিত হই, মালপত্র নিয়ে এগোই। ও বাবা দু কদম যেতে না যেতেই, আরেক ভদ্রলোক আমাদের ম্যাপ দেখতে দেখে,  প্রায় পৌঁছেই দিলেন হস্টেল অব্দি। প্রাগের লোকেরা বড় ভালো। প্রাগ প্রথম দিনেই হৃদয় জিতে নিয়েছে। এত রাতেও দলে দলে অল্পবয়সী ছেলে পুলেরা চলেছে রাস্তা দিয়ে ওই হস্টেলের দিকেই।  হস্টেলের লাউঞ্জেও প্রচুর লোক। এই হস্টেলটা বাচ্ছা নিয়েও থাকা যায়। সই সাবুদ করে এগোতে যাব, বলে কিনা ওহে চাদর দিয়ে যবে না? অ্যাঁ? হস্টেল মানে একেবারে চাদর পেতে নেওয়া হস্টেল! এবার কি মশারিও টাঙাতে বলবে নাকি রে বাবা! সকালে হয়তো ঘন্টাবাজার সাথে উঠে প্রেয়ার করে পড়তেও বসতে বলবে! নাহ সেসব নয়, দেখে চাদর, সুটকেস, লটবহর নিয়ে চললাম নিজেদের ঘরের দিকে...

Thursday, July 31, 2025

ইওরোপে কটাদিন(সালজবার্গ)

সলজবার্গের ট্রেন ছিল অনেকটা সকালে। ঝটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুজন। গুগল ম্যাপ কেন জানি একটু ঘোল খাওয়ায় মাঝে মাঝে। তাড়াহুড়ো করে স্টেশনে ঢুকে প্ল্যাটফর্মে যেতে গিয়ে সে এক ঝামেলা। তা আমরা দুজন একটু হাবা মতো বলে মেনে নিয়েছি, তাই এইসব আমাদের সঙ্গী হবেই সেও জানা। তাও মনে তো দু:খ হয়ই, "এত ছড়ু কেন আমরা"। সেই সব নিয়েই সলজবার্গে পৌঁছলাম৷ সলজবার্গে ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন থেকে কার্ড কেনার সময়, সেন্টারের মেয়েটিই বলল, খরচ কম করতে চাইলে সালজবার্গ কার্ড কিনে নাও আর তারপর বাসে করে লেক সাইডে যাও আলাদা করে। তাতে খরচ কম হবে তোমাদের। তাই করা হল।শুরু হল আমাদের দৌড়াদৌড়ি। আজ দিনটাই আছি খালি। আমাদের ইচ্ছে আছে মোজার্টের বাড়ি, সলজবার্গ দুর্গ টুর্গ দেখে চলে যাব শহরের বাইরে। সলজবার্গ মানে সাউন্ড অফ মিউজিক এর দেশ। পাহাড় লেক ঘেরা সেসব জায়গা ঘুরে শহরে ফিরে রাতের ট্রেন ধরব। হাতে সময় কম বলে মিউজিয়ামে হালকা ঢুঁ মেরেই বেরিয়ে আসব ইচ্ছে ছিল। ও বাবা এখানকার মিউজিয়ামের লোকেরা ভারী ভালোবাসে নিজেদের কাজকর্ম৷ "আরে এটা দেখবে না, সেকি! অন্তত ওইটুকুটা দেখো।" এরকম বলে বলে প্রায় পুরো মিউজিয়ামই ঘুরে ফেললাম।

 মিউজিয়ামটা হেব্বি বানিয়ে রেখেছে। লাল কার্পেট পাতা, এই চওড়া সিঁড়ি। যেন অস্কার নিতে চলে পিঠে বোঁচকা নিয়ে। বড় এত আন্তরিক ভাবে ভালোবেসে দেখাচ্ছিল, আমাদেরও সত্যি বলতে ভালোই লাগছিল৷ মিউজিয়ামটা একদম শহরের মাঝে, ছিল কোনো রাজার বাড়ি। ছাদে বসে কেরম প্রেমসে পাহাড় দেখতে দেখতে চা খেত!! ওহোহো, রাজা হলেই ভালো হত রে। অবশ্য খুব কথা বলত চারপাশ থেকে লোকে, আর রাজ্যের হাবিজাবি শুনে যেতে হত। বেস্ট হত রাজার সেই ছেলে যার সিংহাসন পাওয়ার আশা নেই, কিন্তু খাতিরদারি ষোলো আনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে,  পাশের ঘরে যাই, এখান থেকে চ্যাপেলটার চমৎকার একটা ব্যালকনি ভিউ পাওয়া যায়। এদের কী যেন একটা প্যারাডাইস লস্ট শো চলছে, সেটায় যাবার ইচ্ছে ছিল না তেমন কারণ আমরা দুজনেই আঁকায় যাকে বলে পিকাসোর প্রেত। আমি না দেখে গরু ছাগল আঁকলে এমন বিকট জন্তু হয়, বাচ্ছারা তো ছাড়, বড়রাই আঁতকে ওঠে। তাছাড়া সময়েও কম। কিন্তু ওই,  কর্মচারীদের ঠেলায় ঢুকেই পড়েছি। বেশ চমৎকার সব ছবি। ন্যাংটো অ্যাডাম ইভ আপেল খেয়ে ফস করে পৃথিবীতে এসে জামা কাপড় পড়ে ফেলার থেকেও আশ্চর্য হলুম, ওদের ওরকম জনহীন পৃথিবীতে মসৃন লাল সিল্ক দিল কে? 


মিউজিয়াম ঘুরে, পাহাড়ে চড়ে কেল্লা দেখতে চলেছি। সেই পাহাড়ে চড়ার ট্রেন বা ট্রাম। দুর্গের পুরোটা ট্রেন ওঠায় না, খানিক বাদেই স্বর্গের সিঁড়ির মতো অনন্ত সিঁড়ি বাইতে হয়। হোমলেসদের যেমন পিঠেই সংসার থাকে, আমাদের দুজনের পিঠেও সেরকম মস্ত ঝোলা থাকে সারাক্ষণ।  তাতে ওষুধের বোঁচকা (যা দেখলে লোকে ভাববে এরা বেঁচে আছে কেন? কিন্তু খুবই দরকারি জিনিস। এ জিনিসটা বাদ দেওয়া যায় না),  জলের বোতল, ছাতা আর গাধার মতো অজস্র সোয়েটার ভরা৷ কেন কে জানে অত সোয়েটার ভরার আগে একবার আবহাওয়া কিরকম হতে পারে দেখিনি! ওহো কে জানে কেন কি, ওই যে ছড়ু তাই।  জিভ বার করে হাঁফাতে হাঁফাতে চুড়োয় উঠলাম। উঁচু থেকে শহরটা দেখতে বেশ লাগছে, ছোট শহর। শহরের মধ্যে দিয়েই সলজ নদী বয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা ব্রিজ এপাড় ওপাড়ের জন্য। সকালে যখন ট্রেন স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়েছি, বাস স্ট্যান্ডে এদিক ওদিক খুঁজছি,  কেমন করে ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার যাব, এক আফগান আমাদের দেখে এগিয়ে এসে সাহায্য করলো। কোন জায়গায় দাঁড়ালে বাস পাবো দেখিয়ে দিয়ে গেল। এইটা আমি আগেও খেয়াল করেছি, বিদেশে এলে, পাকিস্তান বলো আফগানিস্তান বলো, একই জায়গার লোক বলেই ভাবে। ঝগড়াঝাঁটি করার জন্যে দেশটা এতোই দূর, দেশের লোক তখন গন্ডী মানে না৷ 




হাঁটতে হাঁটতে গেলুম মোজার্টের বাড়ি।  মানে জন্মস্থান আর কি৷ ভদ্রলোক খুব ঘুরতেন তো! তেমনই খরুচে লোক দেখছি! ধার করে করে আলা হয়ে গেছিল একেবারে! আরিব্বাস এইটাই সেই পিয়ানো, যাতে বসে আশ্চর্য সব সুর তৈরী করতেন! অবশ্য পিয়ানো দিয়ে কী হবে আর, মাথাই হল আসল। আমি এই পিয়ানোয় বসলে সুর বেরোবে বটে, তবে গাধার সুর। 

সলজবার্গের আসল মজা হল তার লেক,পাহাড়৷ সময় কম তাই বলেই একটু সে স্বাদ চেখে দেখবো না তাই কি হয়। সুতরাং সওয়ার হলাম বাসে। এই বাসটা শহর থেকে বাইরে যায়৷ খেয়াল হল এক ফোঁটা জলও নেই সঙ্গে। যে ভদ্রমহিলা বাস চালাচ্ছিলেন, তাকে কাঁচুমাচু করে বললাম রাস্তায় কোথায় জল পাবো? বাসে পাওয়ার উপায় আছে? আফ্রিকান বংশদ্ভূত সে মহিলা তো ভারী দু:খী হলেন শুনে, হাঁকপাঁক করলেন, "আমার কাছে একদম জল নেই আজ, তোমায় দিতাম তাহলে, আমাদের তো এর মাঝে কোথাও এমন দাঁড়াবে না যে জল কেনার সময় পাবে। তবে আমরা যেখানে পৌঁছবো সেখানেই গ্যাস স্টেশনে পাবে। আমি খুবই দুঃখিত, কিন্তু সত্যিই আমার কাছে জল নেই। "  অগত্যা, আর কি করা। এদিকে চারপাশের চেহারা বদলে গেছে। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ,  তার পারে পাহাড়। মাঝে মাঝে এক দুটো বাড়ি। তেষ্টা পেয়েছে, জল নেই সে নিয়ে দু:খ পেয়ে বসে থাকলেও তেষ্টা কমবে না, উলটে চারপাশের এমন মনোরম দৃশ্যও ধরতে পাবো না। কষ্টের কথা ভুলে চেয়ে রইলাম বাইরে। বাস থেকে নেমে এগিয়ে চললাম লেকের দিকে। পাহাড় দিয়ে ঘেরা মন্ডসি লেকের সামনে তখন প্রচুর লোক। ছুটির দিন পেয়ে সকলেই চলে এসেছে। লেকের ধারে গাছের ছায়ায় বসে আছে প্রচুর বাচ্চা আর প্রচুর খাবারদাবার সমেত টার্কিশ পরিবার, কোথাও আছে বুড়ো দম্পতি। টুকটুক করে হেঁটে চলেছে অতি বৃদ্ধ আর প্যারামবুলেটরে করে দাঁত না গজানো শিশু। খাবার দাবারের দোকানে ভীড়, বেশির ভাগই লাইন দিয়েছে আইসক্রিমের জন্যে। আমরাও দিলাম। অনেক অনেকক্ষণ সেই জল, গাছ, ঘাস আর প্রাণের মাঝে রইলাম। 






ফেরার বাসে উঠে টের পেলাম খিদে পেয়েছে বেশ। ভালো কিন্তু সস্তা খাবার দোকান মানেই তুর্কদেশীয় খাবার। একটা জায়গা আছে, শহরের মধ্যেই কিন্তু ট্যুরিস্ট প্লেস থেকে দূরে, অনেকগুলো দোকান। আমাদের কার্ড আছে তাই সমস্যা নেই। বাস বদলে বদলে চললাম সে জায়গায়। তারপর দোকান বেছেবুছে বসে পড়া গেল, কাবাব প্ল্যাটার নিয়ে। এটা আমাদের দেশের চৌকো চৌকো কাবাবের মতো না। সোওয়ারমা থেকে অনেকখানি মাংস নেওয়া হয়, আর প্রচুর স্যালাড, ওদের একটা মিক্সড সস ইত্যাদি সাথে পাঁউরুটি বা ভাত।  

 বিকেলের আলো এখনো শেষ হয়নি, আমাদের সালজবুর্গ কার্ডে একটা ক্রুজের কথা আছে, কিন্তু গুগলে দেখাচ্ছে বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা তো হতাশ, এ বাবা, আগেই যাওয়াই যেত। ঠিক আছে তাও যাওয়াই যাক না ওখানে। এমনিও আমরা নদীর ধারেই যেতামই। গিয়ে দেখি, লাস্ট ক্রুজ বাকি তখনো। তাড়াতাড়ি গিয়ে টিকিট কালেক্ট করা হল। কাউন্টারের ভদ্রলোক বারবার জানালেন, আজ জল কম আছে তাই আধঘন্টা কম ক্রুজ হবে। তারপর যখন ক্রুজে উঠলাম তখনো ক্যাপ্টেন (বেশ দেখতে ছিল ভদ্রমহিলাকে) বারবার দু:খ প্রকাশ করে জানালেন, নদীতে জল কমে যায় বিকেলের দিকে, আজ বেশীই কমে গেছে, নাব্যতা কম তাই আমরা বেশীদূর গেলে আটকে যাব। আমাদের দেশের সাথে তুলনা করে ফেলছি বারবার, কিন্তু তাও মনে পড়েই যায় চট করে, বিভিন্ন ট্যুরিস্ট প্লেসে,  এরকম নৌকা ইত্যাদি নিলে, কেমন গা জোয়ারি চলে। এক ঘন্টা মানে কোনো সময়েই এক ঘন্টা করায় না, সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে! দুর্নীতি বিষয়টা আসলে,  যতক্ষণ নিজেকে এফেক্ট না করে আমরা মনে করি যা করছি সব জাস্টিফায়েড। আমাদের দেশে এ রোগ যাওয়া শক্ত আছে। 
ক্রুজে করে বেশ চারপাশ দেখতে দেখতে চলেছি, কনে দেখা আলো পড়েছে দুপাশে, পাথরের বাড়ি, প্যালেস, গাছ সব সোনার হয়ে গেছে। দ্রষ্টব্য তো হরেক, তার বৃত্তান্তও ক্যাপ্টেন বলছেন, আমি শুনছি বটে তার ভাঙা ভাঙা সালজবার্গ এর ইংরেজি, কিন্তু আসলে চেয়ে আছি চারপাশের এই অদ্ভুত সুন্দরে৷ নামার আগে ভদ্রমহিলা আমাদের ক্রুজটা দুপার পাক খাওয়ালেন জলে, সে বেশ মজার। নদীর ধারে, ব্রিজের উপর ভায়োলিন বাজাচ্ছে একজন, সেই সোনা ঝরা আলোয় সুরের মূর্ছনায় চারপাশটা অদ্ভুত মায়াবী হয়ে গেছে। ব্রিজের উপর তালা ঝুলিয়ে নিজেদের সম্পর্ককে স্বায়ীত্ব দিতে চেয়েছে কতজনায়। তারা আজও বেঁচে আছে কিনা কে জানে! কিংবা তাদের সম্পর্ক হয়ত অন্য কারোর সাথে, কিংবা তালার জোরেই তাদের সম্পর্কও জুড়ে আছে জানিনা, খালি তালাগুলো রয়ে গেছে তাদেরভসেই মুহুর্তগুলোর স্মৃতি নিয়ে। সম্পর্ক থাক বা থাক, মুহুর্তটা তো আর মিথ্যে ছিল না। চিরস্থায়ী কিইই বা হয় এই ব্রহ্মান্ডে! 










পাথরের সিংহের মুখ থেকে জল ভরছিলাম আমরা। খুব সরু হয়ে পড়ছিল, হয়তো আমাদের মতো গরীব ট্যুরিস্ট ছাড়া তেমন কেউ আর আসে না। তা আমাদের পাশেই দুটি মেয়ে বসেছিল, রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যাওয়ার সময়, দুটি ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখে ওদের ডায়লেক্টে জার্মান ভাষায় কিছু বলল, সম্ভবতঃ কিছু প্রস্তাব। মেয়ে দুটি হাসতে হাসতে জবাব দিল, যে মেয়েটির তুলনায় ছেলেটি বেশীই বুড়ো। তাতে ছেলেটিও হেসেই চলে গেল। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়ায় পুরোটা হল। একজন প্রস্তাব দিল, অন্যজন সে প্রস্তাবে অরাজী হল,  সেটুকু সম্মান দিয়ে প্রস্তাবকারী চলে গেল। এমনটাই হওয়া উচিত ছিল না কি সর্বত্র?  ঘোমটায়, বোরখায়, কোরানে পুরানে ব্যপারটা আমরা এত জটিল করে ফেলেছি কেন!? 

ফিরতি পথে সুদীপদের সাথে ট্রেনে মোলাকাত হল। একসাথে চললাম ফিরে। বাড়ি ফিরে চাট্টি ভাতে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়া হবে ঠিক হয়েছে। কিন্তু বলছিলাম না এই ছেলে মেয়ে দুটো খুবই ভদ্রলোক।  বলেছিলাম একবার কথায় কথায়, স্নিটজেল আরেকবার খেলে হত তা সুদীপ দেখি সব মনে রেখেছে। অত রাতেও সে  আমাদের স্নিটজেল ধরে দিয়েছে পাতে। পৃথিবীতে এত ভালোবাসায় যত্নে বেঁচে থাকি সেসব মনে না রেখে স্রেফ অভিযোগেই দিন কাটিয়ে দিই। এই রাতে নরম উষ্ণ বিছানা, পছন্দের গরম খাবার,বন্ধুদের ঘিরে থাকা আর , কর্মঠ সুস্থ শরীর...এর পরেও জীবনকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যায় কি?

Sunday, June 22, 2025

ইওরোপে কটাদিন(ইন্সব্রুক)

 দোতলা ট্রেন সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্যে৷  মুখোমুখি চারখানা সিট খুঁজে নিয়ে বসি চারজনে। একটু গুছিয়ে বসেই চা পান আর পুর ভরা পাঁউরুটি সেবন। ভিয়েনা থেকে সলজবার্গ হয়ে ইন্সব্রুকে যায়  ট্রেনটা। আমাদের গন্তব্য ইন্সব্রুক।  সালজবার্গও যাব ফিরতি পথে। তবে কেবল আমি আর ময়ূরাক্ষী।  বাকি দুজনের আরাম করে সলজবার্গ ঘোরা। আমাদের মতো হুড়োহুড়ি করে সালজবার্গ কেউই ঘোরে না, সালজবার্গ সেরকম জায়গাই নয়। অন্তত চার-পাঁচদিন থাকো, নদীর ধারে হাঁটো, হাইক করো, হ্রদের পাশে শুয়ে থাকো।  যাইহোক, আপাতত ইন্সব্রুকের কথা বলি। সে এক ভারী সুন্দর জায়গা। আল্পসের কোলে, আর এই ভিয়েনা থেকে সালজবার্গ হয়ে ইন্সব্রুকের রাস্তাটাও বড় সুন্দর। মাঝে কিছুটা সময় ট্রেনটা জার্মানি দিয়েও যাবে। মাইলের পর মাইল ফসলের ক্ষেত, সুন্দর সুন্দর বাড়ি। ক্রমে দিগন্তব্যাপী ফসলের ক্ষেতের বদলে পাহাড় দেখা গেল, পাহাড়ের কোলেই ক্ষেত। সালজ নদী পেরিয়ে গেলাম। ট্রেন অনেকটাই খালি এখন। ইস্ট ইওরোপ অনেকটাই চলে বিশ্বাসের উপর। মানুষ ইচ্ছে করে অসততা করবে এ বোধহয় এরা ভাবে না। তাই, ট্রামে বাসে কোথাও টিকিট চেকার থাকে না। একমাত্র মেট্রোয় মাঝে মাঝে চেকিং হয় আর হয় এইসব দূরপাল্লার ট্রেনে। একজন মহিলা চেকার অনেক্ষন আগেই আমাদের টিকিট দেখে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে স্টেশনে থামলে একেকবার এসে দেখে যাচ্ছেন, নতুন কেউ এলো কিনা। 




স্টেশনে নেমে, একটা ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার দেখছিলাম। এটা প্রাইভেট ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার।  তেমন ভালো না। বলে ইন্সব্রুক কার্ড নিলে এখন থেকেই শুরু হবে। এরকম হয় না। এখানে প্রতিটা শহরের এরকম কার্ড পাওয়া যায়। তাতে করে সুবিধে হয়, দর্শনীয় স্থান বেশীর ভাগ এই কার্ডেই দেখা হয়ে যায়। শহরের মধ্যে বাস ট্রামও এই কার্ড দিয়েই হয়ে যায়। পরে দেখা যাবে খন ভেবে রওনা দিলাম৷ একটা বিএনবি বুক করা আছে আমাদের। স্টেশন থেকে বিএনবি যাওয়ার রাস্তায় একটা নদী পরে৷ ইনস নদী না, ওরই কোনো শাখা হবে। তার পাশ দিয়ে দিয়ে রাস্তা। একটা পার্ক। সেই পার্কে বিস্তর শরীর চর্চা করার জিনিস আছে। এদেশে সুস্থ থাকতে গেলে কসরত করার দরকার পরে না খুব। শরীর চর্চা করার অফুরন্ত জায়গা,পছন্দ না হলে সাইকেল চালাও, দৌড়ও, হাঁটো। গরমের সময়ে ঘরে কেউ বসে থাকেও না।  চারিদিকে দৌড়বীর,  সাইক্লিস্ট এর পাশ দিয়ে দিয়ে চললাম। এই বিএনবিটার ঢোকার পদ্ধতি হল, লিফটের  একটা কোড দিলে লিফট খুলবে, তারপর তোমার ফ্লোর দাও। ঘরে ঢোকার আর একটা কোড! রান্নাঘরে ঢুকতে গ্রিলড মাছের গন্ধে চনমন করে উঠলো প্রাণ। দুজন তরুণ তুর্কী মস্ত একটা মাছ গ্রিল করে 'মৎস্য মারিব খাইব সুখে' ভঙ্গীতে বসেছে। আমরা রেডি টু ইট খাবার কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিকেন বাটার মশালা আর ভাত। কিন্তু তাজা মাছ ভাজার গন্ধের কাছে সে আর কি আর মন মানে৷ খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা বেরোলাম ইন্সব্রুক টহল দিতে। প্রথমেই যাব ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার।  ইন্সব্রুক কার্ড কিনে নেব। কাল সারাদিন ঘুরব ইন্সব্রুক চারজন।পরশু সক্কাল সক্কাল ট্রেন ধরে আমি আর ময়ূরাক্ষী যাব সলজবার্গ। সুদীপ মৌসুমী আরেকটু ঘুরবে ইন্সব্রুকে। রাতে একই ট্রেনে ফিরব ভিয়েনা। এখানের ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার গুলো ভারী ভালো হয়। আমাদের যত বক্তব্য শান্ত হয়ে শুনে, সব বুঝিয়ে দিল চমৎকার।  টাকা পয়সা মিটিয়ে চললাম নদীর দিকে। রাস্তাতেই একটা চমৎকার চার্চ, ভিতরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। খুবই সুন্দর কাজ চারপাশে। আমাদের দেশে যেমন গঙ্গাজল কেনা যায় ওরাও দেখি জর্ডনের জল কেনার জন্যে পোস্টার দিয়েছে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই ব্যপারটা বেশ। বেসিক প্রফিটের জায়গায় বেশ মিলমিশ। নীচে কার যেন একটা সমাধি আছে৷ চার্চ,ক্যাথিড্রাল, চ্যাপেলের কিছু তফাৎ আছে, আমাদের দেশে আমরা সবই চার্চ বলি, সে হিসেবে চার্চই বলছি। তো চার্চে ঢুকলে আমার কেমন ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনা ঘরে মতো লাগে৷ সেইরকমই ভাবগম্ভীর একটা ব্যপার, উঁচু উঁচু সিলিং, লম্বা টানা বেঞ্চ। খানিক বসে থেকে, চললুম নদীর ধারে। নদীটার উলটো পাড়ে, ইন্সব্রুকের আইকনিক ছবির বাড়ি গুলো সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে। তার ওপাশে পাহাড়। নদীর ধার ধরে হেঁটে গেলে ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিটা কী যে চমৎকার কী বলি! কাচের দেওয়াল, বই থেকে চোখ তুললেই নদী পাহাড়। শীতে বরফে সাদা হয়ে যায় চারধার আর গ্রীষ্মে সবুজ। নদীর ধারে পাতা একটা বেঞ্চে বসে, ফ্লাস্ক থেকে বের করে চা খাই, পকেট থেকে বিস্কুট বেরোয়। শহর জুড়ে হেঁটে বেড়াই, কখনো দুটো আইস্ক্রীম কিনে ভাগ করে খাই। খিদে পেলে টার্কিশ দোকানে যাই,কাবাব বক্স নিই, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাগ করে খাই।   অনেক অনেক্ষণ পর অন্ধকার নামার মুখে যখন আলো জ্বলে ওঠে চারপাশ, ফেরার সময় হয়ে যায় তবুও দাঁড়িয়ে থাকি ঠায়। অন্ধকার হবার আগে আকাশের রঙটা আশ্চর্য রকম অন্য হয়ে যায়, সে রঙীন লিখে বোঝানো যায় না। দাঁড়িয়ে দেখছি নদীর অন্য পাড়ে একটা দুটো করে আলো জ্বলছে, মুহূর্তটা ধরে রাখতে নিজেদের একটা খারাপ সেল্ফি তুলছি, এমন সময় একজন ভদ্রমহিলা ছবি তুলছিলেন, বললেন তোমাদের একটা ছবি তুলে দিই? দিলেন, তারপর একটু কথাও হল। চীনা অরিজিন, আমেরিকান। এখন অবসর নিয়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান আর ছবি তোলেন। বেশ ফূর্তির জীবন।








ফিরতি পথে একটা রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে আসছি, দেখি নারী পুরুষ মিলে চমৎকার নাচ গান হচ্ছে। চমৎকার সালসা নাচছে। গিন্নি জানেন খানিক নাচ, আমার নাচ মানে ভাসান ডান্স। বাকি দুই মক্কেল  জানেননা বলেই দাবী করেন, তবে ছুপা রুস্তম আছেন। দূর থেকেই তাই দাঁড়িয়ে দেখা হল। এত এনার্জেটিক, এত প্রানোচ্ছল বড় ভালো লাগছিল। আমরা ক্লান্ত, আমাদের গিয়ে খিচুড়ি রাঁধতে হবে, আমাদের কাল সকালে উঠে বেরোতে হিবে এসব ভুলে গিয়েই হাঁ করে তাকিয়েছিলাম অনেক্ষণ। খিচুড়ি তো বানানো হবে, ব্যাগে করে চাল ডাল আলু ফুলকপি সব এসেছিল, কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে? এক রাউন্ড চা হয়ে যাক নাকি? খিচুড়ি ডিমসেদ্ধ বসিয়ে,  চা, মুড়ি সমেত বসা গেল রান্নাঘরে। সুদীপের গান শোনা পেন্ডিং আছে বহুদিন,  অন্য সময় কান কট কট করছে, পা ব্যথা এসব বলে কাটায়, দুই জন মহিলার সঙ্গে পেরে ওঠেনি সেদিন। সুদীপ দিয়ে শুরু হল, তারপর অন্তাক্ষরীতে চলে গেলাম। সেদিন মজলিশ যা জমেছিল না! আরো বহুক্ষণ চলতে পারতো, তবে খিচুড়ির গন্ধে ফের খিদে চনমন করে ওঠায় থামতেই হল বেয়াক্কেলের মতো। 


ইন্সব্রুক টপে নাকি পেল্লায় ঠান্ডা। আল্পসে উঠছি বলে কথা, ইন্সব্রুকের জন্য গাদাগাদা সোয়েটার নিয়ে গেছিলাম। ইন্সব্রুকে বেশ গরম। টিশার্ট পরে ঘোরার বদলে শার্ট আর ব্যাগে সোয়েটার নিয়ে বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে আমরা ইন্সব্রুক ঘুরেছি।খানিক হাবা মতো আছি বটে। সকাল সকাল চা ম্যাগি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ইওরোপে(ইউএসেও) সকাল তাড়াতাড়িই হয়। লোকজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে,  কফি, পাঁউরুটি কিনে অফিস যায় সকাল সকাল। আমাদের মতো রাত দশটা অব্দি কল করতে হয় না, তাই তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। আমরাও আমাদের সারাদিনের খাবার মতো স্টাফড পাঁউরুটি, কলা, জুস, সিডার এসব তুলে নিলাম। ইন্সব্রুকের পাহাড়চূড়ায় পৌঁছতে গেলে একটা ট্রেন নিতে হয়। ইন্সব্রুক কার্ডেই ইনক্লুডেড সব, তাই আলাদা টিকিট কাটার প্রয়োজন নেই। ট্রেন মানে আমাদের মতো অনেক কামরা ওয়ালা ট্রেন না, ট্রামের মতো তিনটে কামরা আছে, খাড়াই উঠতে পারে। বসার জায়গা অল্প।দাঁড়িয়ে যেতেই ভালো লাগে বেশী। ট্রাম বলাই ভালো হবে দেখছি একে৷ ট্রামে করে পাহাড়ের মাঝের একটা জায়গায় নামা হল। এর পরে আর ট্রাম চড়বে না। কেবল কার, মানে ওই বন্ধ রোপওয়ে আর কি।  যে জায়গায় নামলাম সেখান থেকে পুরো ইন্সব্রুক শহরটা দেখা যায়। দূরবীনে চোখ রেখে চেনা যায় শহরের বিখ্যাত জায়গা গুলো। পাহাড় এখন হাতের নাগালে প্রায়। বসে বসে ছবি তুললে মনে হবে কাকা পাহাড়ের কোলে চড়েছি, আর খোকার ছবি তুলেছে কেউ। বরফ গলে গেছে বেশীরভাগ, অল্প আধটু আছে, উপর থেকে নীচে তাকালে সবুজে সবুজ আর উপর দিকটা রুক্ষ। 





কেবল কারে বেজায় ভীড়। তারমধ্যেই কাচের দেওয়াল দিয়ে দেখি  নীচে তাকিয়ে কয়েকজন পাগল সাইকেলে করে পাহাড় বাইছে, স্ফূর্তির অভাব কিছু আছে বলে মনে হয়না এই পরিশ্রমেও। অনেকে হাইক করছে। কেউ কেউ নীচে গাছের নীচে বসে বসে বই পড়ছে বা খাওয়া দাওয়া। উজ্জ্বল দিন।  রোপওয়ে পৌঁছে দেবার পর, অল্প পাহাড় বাইতে হয় একদম চুড়োটায় উঠতে গেলে। এখান থেকে কয়েকজন প্যারাগ্লাইডিং করার চেষ্টায় আছে।  পাহাড়ের খাঁজে বসে সবে আমাদের খাবারের ঝোলা হাতড়ে বের করেছি জিনিস্পত্র, বেশ কটা সাহসী পাখি এসে হাজির। পারলে গায়ে মাথায় উঠে বসে।  






উপর থেকে নেমে আসার পথে একটা চিড়িয়াখানা পড়ে। অ্যালপাইন জু। আমাদের টায়ার্ডনেসের জন্যে হোক, ম্যাপ বুঝতে না পারার জন্যে হোক অত ভালো কিছু দেখা গেল না, কিছু দেখা হল। এরা ব্যাটারা ভেড়া, গরু, রামছাগল সব রেখেছে চিড়িয়াখানায়। গন্ধে আকুল হয়ে যাবে ওই জায়গাটা পেরোতে। তাও ম্যাডাম গরু বলে কথা, তামাম ভারতবর্ষের মসীহা হয়ে খড় চিবুচ্ছে, তার দর্শন তো করতেই হয়! একটা গাছের পাশে একটা কবর, জন্তু জানোয়ার কছু নেই বোঝাই যাচ্ছে।  কিন্তু জায়গাটা বড় ভালো। বড় বড় গাছের ছায়া, লোকজন নেই।  আমাদের লাঞ্চের আদর্শ জায়গা বলা যায়। পানাহার এর পর্ব শেষ করে বোঁচকা বেঁধে ফেরার ট্রেন ধরতে প্ল্যাটফর্মে এলাম। এদের দেশে লোক কম, তাই হয়তো জীবনের দাম বেশী। প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনের মধ্যেকার ফাঁকটা ট্রেন এসে দাঁড়ালে স্বয়ংক্রিয় ভাবে একটা লোহার পাটাতন এসে ঢেকে যায়৷ দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আবার সে নিজে থেকে গুটিয়ে যায়৷ শহরে এসে আমরা খানিক এদিক সেদিক ঘুরলাম।প্রথমে অ্যামব্রেস কাসলে একটা ঢুঁ মারা হল। শহর থেকে একটু তফাতে এই কাসলটা। কম কম বাস যায়। স্টপেজ এলে আমাদের ট্যুরিস্ট বুঝে যাত্রীরাই ইঙ্গিত করে নামিয়ে দিল। হরেক রকম মস্ত মস্ত গাছ, পুকুর, মাঠ দিয়ে ঘেরা বেশ কাসল। বেজায় রোদ বলে একট বেঞ্চে জিরিয়ে নিচ্ছি, ঝিম ধরে আসে প্রায়, এমন সময় ক্যাঁ ক্যঁ করে কর্কশ ডাকে তাকিয়ে দেখি এক জোড়া ময়ূর। এ তাদেরই বাড়ি, সুতরাং ভয়ডর নেই। খুঁটে খুঁটে পোকা টোকা খাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। এমন চমৎকার দেখতে একটা প্রাণীর এমন কর্কশ ডাক ভাবা যায় না! অবশ্য না যাবারও কিছু নেই। যা বাইরে সুন্দর তাইই অন্তরে সুন্দর হলে আর এত যুদ্ধ হয়  চারপাশে! অনেকদিন আগে সম্ভবতঃ অটোমান রাজত্বের সময়, এক সৈনিক ছিল, নাম গ্রেগর বাচি, সে তার ডান চোখে বর্শার আঘাত পেয়েছিল। বা বলা ভালো তার ডানচোখ হয়ে খুলি ফুঁড়ে একট বর্শা ঢুকে গিয়েছিল এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তারপরেও সে বেঁচে গিয়েছিল। একটা স্কাল্পচার বানানো আছে তার খুলি আর ওই বর্শার টুকরোর কাসলের ভিতরে। আরো হরেক জিনিস আছে এক্সোটিক বলে অংশটায়।  তার মধ্যে হাতির দাঁতের অতি সুক্ষ সব কাজ, ড্রাকুলা নামে খ্যাত তৃতীয় ভ্লাদের ছবি ইত্যাদি। একটা ছবি বেশ অবাক করায়,  কিংবা অবাক না হবারই কথা, রাজাকে উপহার দেওয়া হয়েছে একজন বিকলাঙ্গ মানুষ। এক্সটিক বটে! বর্ম, অস্ত্রের যেমন সম্ভার থাকে তা তো আছেই, তার মধ্যে এক প্রকার বর্ম অবাক দেখে আমি তো যাকে বলে এক গাল মাছি! হাত পা বুক মাথা নাক সব সুরক্ষিত,  এদিকে আসল দুর্বল জায়গাটিই ফাঁকা! তাই বলি গালিয়থ কী করে ডেভিডের একটা গুলতির আঘাতেই ঘায়েল, টাকে উঠে যাওয়া ব্যপার! 


ওখান থেকে একটা লেকের ধারে যাওয়া হল। সেও শহর থেকে খানিক দূরে। লেকের পাশে এক আইস্ক্রীমের দোকানে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। এখানে ছেলে বুড়ো সব্বাই আইস্ক্রীম খেতে বেজায় ভালোবাসে। আর খেতেও হয় চমৎকার।  হরেকরকমেকরকম ফ্লেভার, তার থেকে একটা পছন্দ করো। আমরাও করলাম। আইস্ক্রীম খেয়ে লেকের ধারে বসে,  শুয়ে রইলাম বহুক্ষণ। মাঝে মুড়ি খাওয়া হল, কলা খাওয়া হল।  লেকের নীচটা পাথুরে মতো, জলে নামতে গেলে পায়ে বেধে। তাতে কি কারোর ভ্রুক্ষেপ আছে! সব ছেলে মেয়ে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে ঝপাং! কেউ শুয়ে রোদে ট্যান হচ্ছে, কেউ বই পড়ছে। গ্রীষ্মকাল যে হাজির তা বোঝা যায় বটে। দুটো জিনিস চোখে পড়ে, আব্রু নিয়ে এদের এত মাতামাতি নেই, বহু ছেলে-মেয়েই সামান্য আড়ালে গিয়ে বা না গিয়ে ভিজে পোশাক বদলে নিচ্ছে। আমাদের গঙ্গার ঘাটে যেমন করে চান করে উঠে, প্রায় তেমনই। কেউ তাকিয়ে দেখছেও না। আর পাবলিক টয়লেট গুলোও অতি পরিষ্কার। সন্ধ্যে নামার  মুখে ফেরার পথ ধরলাম।


ইন্স নদীর ধারে ফিরে ইতস্তত: ঘুরছি।একটা ভারতীয় দল ট্যুর এজেন্সির সাথে এসেছে দেখছি, ওই হয় না এজেন্সি গুলোর "লেজার টাইম",  সেরকম কিছু হবে, দলের বেশীরভাগ লোক লোকজন পার্কে বসে জিরুচ্ছে। হাঁটার অভ্যেস না থাকলে বিদেশে অসুবিধে আছে ঘোরার এ কথা সত্যি। হ্যাঁ, বাস-ট্রাম সবই খুব আছে, কিন্তু ঘুরতে গেলে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই কিন্তু। তাছাড়া বাস ট্রাম সর্বদা নির্দিষ্ট জায়গায় থামে, সারা রাস্তাটাউ আমার স্টপ না কিংবা নির্দিষ্ট জায়গাতেই খাবার পাওয়া যায়, সারা রাস্তাটাই আমার রেস্তোরাঁ না। ঘুরতে ঘুরতে শেষ বিকেলে একটা গীর্জায় ঢুকেছি, সে সময় তাদের প্রার্থনা চলছিল। কল্পনা করতে আমি ভালোবাসি। কত সময় তুচ্ছ তালা চাবি নিজেদের মধ্যে কী কথা বলতে পারে  জাতীয় কল্পনা কিংবা পিঁপড়েদের মানুষ সম্পর্কে ধারণা আমি কল্পনা করে থাকি। কিন্তু কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে চাট্টি ফলমূল কিংবা নকুলদানা কিংবা পাঁউরুটি কিংবা খেজুরের লোভে পাঁচটা বাজে আবদার কি কান্নাকাটি সইবে এটা আমার মতো কল্পপ্রাণ লোকও ভাবতে পারে না। তবে তা আমি মন্দির মসজিদ গীর্জা গুরুদ্বোয়ারা কোত্থাও প্রকাশ করিনা। পেটের কথা চেপে রাখলে যদি মিষ্টি টিষ্টি পাওয়া যায় মন্দ কি! তাছাড়া সত্যি বলতে নির্জন চার্চে, মন্দিরে, মসজিদে বসে থাকতে আমার ভালোই লাগে, বিশেষ করে গ্রীষ্মের দিনে। আর ভালো লাগে, গান। ভগবানের উদ্দেশ্যে হওয়া বেশীর ভাগ গানের সুরই আমার বেশ লাগে। তো যে গীর্জায় যখন গেছি, তাদের প্রার্থণা চলছে। অনেকে মিলে বসে, গীটারে গান ধরেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম অনেক্ষণ।  তারপর বেরিয়ে নদীর ধারে। ইন্সব্রুকে এই আমাদের শেষ রাত। যতক্ষণ পারি চেটে পুটে নিই।





Saturday, June 7, 2025

ইওরোপে কটাদিন(ভিয়েনা পর্ব ২)

শনব্রুন প্যালেস অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত জায়গা। মানে সত্যি বলতে এটা ভালো করে দেখতেই পুরো দিন চলে যেতে পারে। মনে আছে সেই এম্ব্যাসি থেকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, কী দেখতে চাও অস্ট্রিয়ার? তা সে সময় আমার ভিয়েনায় শনব্রুন ছাড়া আর কিছু মনে পড়েনি। কে জানে তাতেই কনভিন্স হয়েছিল কিনা! যাকগে, তো শনব্রুন হল, ওই হাবসবুর্গারদের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান। জন্মালে রাজা হওয়াই ভাল মশাই। রাজাদের যুদ্ধ করতে হয়না, যুদ্ধ করে সেনাপতির ইন্সট্রাকশনে সৈনিকরা, কূটনৈতিক বুদ্ধি দেয় মন্ত্রীরা, টাকা দেয় প্রজারা। রাজার কাজ আরাম করা। শনব্রুন বিখ্যাত জায়গা, সকাল থেকেই লোক প্রচুর। তবে জায়গাটা এতই বিরাট অসুবিধে হয়না। মিউজিয়াম দেখার সময় নেই, মামে যে পরিমান টিকিটের টাকা সেটা দিয়ে একঘন্টা মিউজিয়াম দেখে চলে আসার মানেই নেই। এমনিই আমাদের মিউজিয়াম দেখতে সময় লাগে।  তা আশপাশ দেখবো, যদিও বিরাট এক্সপেক্টেশন ছিল না। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে দেখি, ওরে বাবা এ তো বিরাট বাগান হে! রাজা রানীদের পায়ের জোর ছিল বলতে হবে! বাগান মানে সাজানো ছোট ছোট গাছের বাগান না। বিরাট এলাকা নিয়ে, বড় বড় গাছ, সেই গাছগুলকেই ছেঁটে গাছেদের প্রাচীর করেছে কোনো কোনো জায়গায়। যেমন বেড়া দিতে দেখি না? ওরকমই খালি এক্ষেত্রে বৃক্ষ। ঘাসে ঘাসে বসন্তের আগমনী, হলুদ, সাদা ফুল। যতই হাঁটি যতই ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়ি করে বড়লোক ট্যুরিস্ট চলে যাচ্ছে। ঘোড়াগুলো ভারী চকচকে এখানে।  হাঁটতে একটা পাহাড়ের ঢাল এলো। ট্রেইল আছে, ঘাসের মাঝ দিয়ে। আধখানা রাস্তা উঠলে বসার বেঞ্চ আছে। ওখান থেকেই শনব্রুন সহ ভিয়েনা শহর দেখা যায়। মোলায়েম রোদ, শান্ত পরিবেশ, চুপ করে বসে ছিলাম অনেক্ষণ। অনেক অনেক দিন অব্দি এক বেঞ্চে বসে টিফিন বক্স থেকে বের করে পুরভরা বেকড পাঁউরুটি খেতে খেতে চারপাশ দেখার আনন্দটা মনে থাকবে। কী জানি কেন,  আমাদের দেখে হয়তো মানুষজনের মায়া হয়, নিজে থেকেই এসে অনেকে বলে ছবি তুলে দেব তোমাদের? এবারের পুরো বেড়ানো জুড়েই তাই হয়েছে। এত অযাচিত ভালোবাসাও মনে থাকবে বহুদিন। 


ওখান থেকে চললুম বেলভেডেয়ার প্যালেস। সাজানো গোছানো প্যালেস যেমন হয়। ভারী সুন্দর কম্বিনেশনে ফুলগাছ বসিয়েছে। এক ভদ্রলোককে দেখলাম চুপ করে একটা গাছের নীচে বসে আছেন। আরেকজন বই পড়ছেন। দুজন মানুষ চুপচাপ পাশাপাশি বসে। কেউই ফোন ঘাঁটছেনা। দেশে ফিরে আমাকেও মোবাইল ব্যবহার কমাতে হবে।

 hundertwasserhaus বলে একখান বাড়ি আছে এখানে। hundertwasser নামে এক আর্কিটেকচার তৈরী করেছিল বাড়িখানা। বাড়িটায় দুশোটার বেশী গাছ আছে, ছাদে আর ব্যালকনিতে মিলিয়ে। গাছেদের ভাড়াটে হয়ে মানুষ আছে বলা যায়। বাড়িটার স্ট্রাকচারটাও অন্যরকম। এই hundertwasser  ভদ্রলোক একজন আর্টিস্ট ছিলেন, তারপর হলেন আর্কিটেকচার। ফলে অন্যরকম একটা বাড়ি তৈরী হল। তা ইওরোপ তো বানিজ্য ভালোই পারে, ফলে উল্টোদিকেই এই ভদ্রলোকের কাজের ছোট ছোট মিমিক আর্ট বানিয়ে বিক্রিবাটা করার দোকানপাট করেছে বেশ।  দোকানগুলো,ট্র‍্যাডিশনাল দোকানের মতো না করে খানিক কায়দা মতো করে সাজানো, ইন্টেরিয়রও তাই। ফলে পুরোটা ঘুরতে মন্দ লাগেনা। কিছু কেনাকাটার প্রশ্নই নেই যদিও! 


আমাদের পকেটের জোরের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তাও কী খেয়াল হল এখানকার বিখ্যাত ক্যাফে সেন্ট্রালে অ্যাপেল স্ট্রুডেল খেতে যাই চল। তখনো খাইনি জিনিসটা। তা চলো একবার দেখাই যাক বলে যাওয়া গেল। ইওরোপের গলি যেমন হয়, কব্ ল স্টোন রোড বলে যাকে আর কি। এরা একই রকম পুরোনো ভাবটা বজায় রাখায় সেই বিকেলে মনে হয় যেন এক্ষুনি খটাখটা করে কোনো সৈনিক এসে হাজির হবে,  কিংবা কোনো ঘোড়সওয়ার।  ভাবতে ভাবতেই, দেখি একটা ঘোড়ার গাড়ি খটরমটর করতে করতে করতে আসছে। আগেই বলেছি ব্যবসা ভালোই বোঝে এরা। আর সৌন্দর্য বোধটা আছে বলে সেই ঘোড়ার গাড়ির সাথে একটা ট্রে মতো জুড়ে দিয়েছে ঘোড়ার পিছনেই যাতে করে ঘোড়া মলত্যাগ করলে রাস্তায় নোংরা করতে করতে যাবে না, ওই ট্রেতেই কালেক্ট হয়ে যাবে। ক্যাফে সেন্ট্রালে লাইন পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে খুবই বিখ্যাত। আমাদের এসব জায়গা যাওয়ার কথা না, তাও ওই আর কি। লাইন দিয়ে ঢুকলাম৷টেবিলে বসে মেনু কার্ড দেখলাম।ধরুন  মেঘলা দিন, বেশ ভালো করে খিচুড়ি ঘি, বেগুনি ডিমভাজা দিয়ে খেয়ে একটু চোখ লেগে গেছে, স্বপ্ন দেখছেন, পাহাড়ি রাস্তায় একটা পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটছেন। সেসময় টিমস কল এলো, যেরকম ধড়মড় করে  চোখ, নাল টাল মুছে যেভাবে বাস্তবে ফেরেন ওরকমই হল মেনু কার্ড দেখে। অগত্যা কী আর করা। অগনিত বার, কলেজ পড়ার সময় যেমন মেনু কার্ড দেখে চুপচাপ চলে আসতাম, সে জিনিসেরই রিপিট টেলিকাস্ট করতে হল। 



একটা সময় ছিল যখন দানিয়ূব এতই চওড়া হয়ে গিয়েছিল, পলিতে পলিতে ভারক্লান্ত হয়ে দুকূল ছাপাতো। ভিয়েনা প্লাবিত হত। তা প্রথম বিশ্বের সরকার নিজেদের দেশের প্রতি খুবই লয়্যাল। ওরা চুরি ডাকাতি যাইই করে সব তৃতীয় বিশ্ব থেকে। ফ্রান্স আজও আফ্রিকার দেশ গুলো থেকে ট্যাক্স আদায় করে, কারণ আফ্রিকার দেশগুলো নিজেদের টাকায়, নিজেদের রিসোর্স দিয়ে নিজেদের দেশে রাস্তা, ব্রিজ ইত্যাদি বানিয়েছিল। অবশ্য ফ্রান্স সেসময় নিজের ইচ্ছেয় গিয়ে ওদের থেকে জিনিসপত্র লুন্ঠন থুড়ি এমনিই না জোর করে নিয়ে আসছিল। তাই আজও ট্যাক্স নেয়। বা এই যে এত অস্ত্র তৈরী করে প্রথম বিশ্বের দেশ, তৃতীয় বিশ্ব একটু নিজেদের মধ্যে না লড়লে বেচারার কাকে বিক্রি করবে সেসব? আমাদের দেশের নেতারা অবশ্য নিজেদের লোকেদের ছিবড়ে করেই মোক্ষ লাভ করে। যাই হোক, যা বলছিলাম, এদের সরকার বাঁধ দিয়ে খাল খেটে, একটা বিরাট দ্বীপ বানিয়ে নেয় এইখানে যাতে করে বন্যা থেকে বাঁচা যায়। সে দ্বীপ সবুজে সবুজ। লোকে দৌড়চ্ছে, হাঁটছে, মাছ ধরছে। আমরাও গেলাম।ঘড়ির কাঁটায় ছটা পার হয়ে গেছে এদিকে আকাশ দেখলে মনে হবে এখনো বিকেল।আকাশ পরিষ্কার নীল, সেই নীলে দানিয়ূবও ঘন নীল। আচ্ছা দানিয়ূব নদ না নদী? দানিয়ূব নামটা অবশ্য মহিলা নাম নয় ঠিক।।  রোদ মেখে মেখে হেঁটে বেড়ালাম, দানিয়ুবের জলে হাত ডোবালাম। এদেশে জলের জন্যে রাস্তায় রাস্তায় কল আছে, একটু খুঁজে নিতে হয়। তবে আমাদের মতো যে কোনো জায়গায় যে কেউ চাইলেই জল দেবে এমন না। তবে যেহেতু কলের জল খাওয়া যায়, তাই লোকে টয়লেট থেকেও জল ভরে নেয়। আমার একটু ইয়ে আছে বলে সেটা পারিনি। অনেক জায়গাতেই পুরানো দিনের হাত দিয়ে ঘোরানো টিউবওয়েল আছে। এই দ্বীপেও ছিল একটা,  একটু অন্য রকম আমাদের দেশের মতো না, একবার হ্যান্ডেল ঘোরাও করো তারপর জল খাও। একটা ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছি, একটা আইসক্রিম ওয়ালা ঠেলা নিয়ে গেল। কোয়ালিটি ওয়ালস এর মতো লোগো। নদীর ধারে পাব আছে, কয়েকজন পুরুষ নারী বসে বসে বিকেলের আলোয় পানীয় নিয়ে গল্প করছে। সাইক্লিং করছে অনেকে। সব মিলিয়ে বড় মনোরম চারপাশ, ঘড়ি কাঁটা কখন ঘুরে যায় টের পাওয়া যায় না, ছবি তোলা ছাড়া ফোন দেখতেও ইচ্ছে করে না। 


অনেকক্ষণ কিছু খাইনি খেয়াল আছে? মৌসুমী সুদীপের অফিস শেষ, আজ আমাদের সান্ধ্যপিকনিক।  হাঁসভাজা, আর কী কী সব ভালো ভালো খাবার নিয়ে পার্কে বসা গেল। হেঁটে হেঁটে পা প্রায় খুলে এসেছে তখন। সুদীপটার পায়ে নির্ঘাত চ্যাটজিপিটির মডেল লাগানো আছে, চ্যাটজিপিটির যেরকম যতই প্রশ্ন হোক বিরক্ত হয়না, সুদীপও যতই হাঁটা হোক ক্লান্ত হয়না। সন্ধ্যের আবছা আলোয়, অতি সামান্য আয়োজনে আমাদের চারজনের ফূর্তি দেখে কে! একটু দূরে আরেকটা জায়গা আছে। হালুয়া আইস্ক্রীম পাওয়া যায়। এক দফা খেয়ে আমরা চললুম, সে জিনিস খেতে। জিনিসটার হদিশ সুদীপই দিয়েছে। ছোট্ট টার্কিশ দোকান। বেশ খেতে জিনিসটা। পেস্তার ফ্লেভার হালুয়া আইস্ক্রীম।  অন্ধকার ফাঁকা বিদেশী অচেনা শহরে বন্ধুদের সাথে বসে থাকার এই সন্ধ্যেটাও মনে থাকবে বহুদিন। ও হ্যাঁ টার্কিশ নারীদের দেখতে বেশ হয় কিন্তু। 
হাবাদ্বয় আমরা আর সুদীপ -মৌসুমী


না  এফেন্দি আমরা হালুয়া খাব


আইসস্ক্রীম হালুয়া


রাত নামে ক্রমে। আমাদের এনার্জিটা দেখেছেন একবার!! বাপরে বাপ! সেই সকালে শনব্রুণ প্যালেসে বাগানে এন্তার হাঁটাহাঁটি দিয়ে শুরু হওয়া দিন হালুয়া খেয়েও থামেনি।আমরা চললুম রাতের ভিয়েনা দেখতে। সুদীপ বলেছিল, 'ভিয়েনার নাইট লাইফ বলে কিছু নেই, এরা দিন শুরু করে তাড়াতাড়ি আর রাত নামলেই ঘুমিয়ে পড়ে।' কিন্তু আমি ঠিক পার্টি অ্যানিমাল নই, মোচ্ছব করতে যাচ্ছি তাও না। স্রেফ দেখবো, একটা শহর রাতে কেমন হয়। ওই যে অত বড় বড় স্থাপত্য,  হলুদ আলোয়, পার্কের ছায়ার কেমন লাগে।রাতের ভিয়েনা সত্যিই নিষ্প্রাণ, অবশ্য একটা দুটো লোক এই রাতেও ছুটে চলেছে দেখছি! দু চারটে রেস্তোরাঁয় লোকজন বসে আছে খাবার পানীয় নিয়ে। সত্যি বলতে যে কোনো জায়গাই মানুষ থাকলে একরকম,  না থাকলেই কেমন আবছা মতো অচেনা মতো হয়ে যায়। সবাই যেন নি:সাড়ে অপেক্ষা করে কতক্ষণে আমরা চলে যাব, নিজেদের মধ্যে ফের গল্প আড্ডা মারবে। "জানিস আজ একজন বুড়ি একা একা ঘুরছিল, স্প্যানিশে কথা বলছিল।" " উফফ আজ চীনাদের দলটা কিছু বড় ছিল"! "আজ রোদ্দুরে লোক খুব হয়েছে, একটা দিন  গেল বটে"। "হ্যাঁ রে ওই যে বোঁচকা বেঁধে দুটো ছেলে মেয়ে এসেছিল, ওরা কি হোমলেস? অত বড় ব্যাগ নিয়ে ঘোরে কেন? দেখ দেখ আবার এসেছে, চুপ চুপ"।  

রাতের ভিয়েনা

ওদের প্রাইভেসীতে আর ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চলে আসি গুটি গুটি। কাল সক্কালেই উঠে যাওয়া আছে। আল্পসের কোলে...