একদিন গেলাম ওয়ার মিউজিয়ামে। লন্ডনে মিউজিয়াম গুলো ঘুরে বেরালেই চমৎকার ইতিহাস জানা যায়। দু:খজনকভাবে কোলকাতা মিউজিয়ামটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আরেকটু যত্ন আত্তি কেন করে না বলে বড় আপশোস করেছি। আলিবাবা চল্লিশ চোরের গুহা মানে ব্রিটিশ মিউজিয়াম নিয়ে অন্য পোস্টে লিখবোখন। যাই হোক, ওয়ার হিস্ট্রি নিয়ে আমি খুব উৎসাহী না। মানে এই বন্দুক, ওই যুদ্ধাস্ত্র এসব অমুক জায়গায় ব্যবহার হয়্রছে দেখলাম ঠিক আছে বরং ওই সময়ের লোকেদের কেমন অবস্থা ছিল জানতে বেশী ভালো লাগে। এনিশিয়েন্ট হিস্ট্রির জিনিসপত্র দেখলে বেশী বিস্মিত হই আর কি। যাইহোক এটা সেটা পার করে গেলাম হলোকাস্ট গ্যালারি দেখতে। জানি মোটামুটি সবাই তাও চোখের সামনে ওই বীভৎস হত্যাকান্ডের ছবি দেখলে একটু নড়ে যেতে হয়। কী ছিল থেকে কী হল অব্দি দেখিয়েছে ওরা। বিভিন্ন ফিল্ম, রেকর্ডিংস, ক্লিপিংস। মানে এতটাই খারাপ করেছিল, ব্রিটিশ সেনা যারা ওখানে গিয়েছিল তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখছিলাম মারাত্মক। বিবিসির যে রিপোর্টার এটা দেখে বলছিল, প্রথমে তার কথা কেউ বিশ্বাসই করেনি। ছয় মিলিয়ন জিউশ মেরে ফেলেছিল!! ছয় মিলিয়ন শুনে আমি কর গুনতে থাকি, ষাট লক্ষ! এতগুলো লোককে স্রেফ "অপর" বলে মেরে ফেললো!! যা খুশী তাই করেছে, যেভাবে খুশী অত্যাচার করেছে। আসলে ওদের মানুষ বলেই ভাবেনি। গুলি করেছে বিবস্ত্র করে একদলকে, সেই উলঙ্গ মৃতদেহের উপরে শুইয়ে, পরের উলঙ্গ দলকে গুলি করেছে। কাউকে বলে কাজের জন্যে নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে গিয়ে গুলি করেছে। কোনো দলকে জ্যান্ত জ্বালিয়েছে। বিবিসির ওই লোকের ভয়েস রেকর্ডিং শুনছিলাম। বলছে, মানুষগুলো বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটা বুঝতেও বেগ পেতে হচ্ছিলো, যেন পালিশ করা স্কেলিটন বলে মনে হচ্ছিলো।
কত হাতে লেখা চিঠি। কেউ স্ত্রীকে ছেড়ে যাচ্ছে মানে বাধ্য হচ্ছে কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে যেতে, কেউ স্বামীকে কেউ বাবা মাকে মিস করে চিঠি লিখছে। একটা বাচ্ছার চিঠি ছিল, সে দাদু ঠাকুমার সাথে ছিল, তার বাবা মা থিয়েটার করতে রাশিয়া গেছিল। সে লিখছে বাবা মা'কে সে খুব মিস করছে, অনেক কেক খাচ্ছে। নতুন স্কুলে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তার ঠাকুমা লিখছে এত কেক খেয়ে এবার সে হয়তো ওয়েট গেন করবে। এ চিঠির কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।বিবিসির ওই ভদ্রলোকের রেকর্ডিংের একটা জায়গায় বলছে, যখন ব্রিটিশ সেনারা যায় তখন তাদের কাছে এক মা তার বাচ্ছার জন্যে দুধ চাইছে কারন তার বুকে আর দুধ নেই। তাই বাচ্ছাটা খেতে পাচ্ছে না। তারপর, বাচ্ছাটাকে যখন নামিয়ে রেখেছে, খুলে দেখে বাচ্ছাটা অনেকদিন আগেই মরে গেছে, তার মা টের পায়নি, কিংবা পেয়েছে!
গ্যালারিটা শুরু হয় একটা হাসিখুশী আনন্দের ছবি দিয়ে। ইউহুদিরা কেমন ছিল, পিকনিক, সাঁতার, হাসি তামাশার দিন, ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিকটাও ওরকম। আস্তে আস্তে এগোই, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বদলে যায়। চাপা টেনশনের মিউজিক চলে। প্রথম ক্রিপল্ড,মেন্টলি ডিস্যাব্লড বাচ্চাদের বেটার শেলটার দেবে বলে, নিয়ে যাচ্ছে। বাবা মা খুশী, ভালো হবে। আমার সন্তানের ভালো চায়। তারপর? ক্লিপিংস আসে, তাদের চান করিয়ে, খেলবে বলে দরজা বন্ধ করে দেয়। ইউথেনশিয়া করে দিল কারন এরা রাষ্ট্রের বোঝা! অবশ্য তার আগে লোকজনের মধ্যে প্রচার করেছিল, এত টাকা, জনগনের ট্যাক্সের টাকা যাচ্ছে স্রেফ এই সব বাচ্ছাদের জন্যে! ভাবো এই টাকায় তোমাদের কত উন্নতি হত!
টেনশন মিউজিক বাড়তে থাকে। পট পরিবর্তন হল, ন্যাশনাল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলো। ক্রমে ইহুদিদের ঘেটো করে আলদা করা হচ্ছে, ইহুদি মরে পড়ে থাকছে, সাধারণ লোকে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। ওই যে ক্যাম্প, ওই যে উলঙ্গ হাড় সর্বস্ব পুরুষ মহিলার পাহাড় এ একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে অবিশ্বাস, পারস্পরিক ঘৃনা, ইগ্নোরেন্স, মিথ্যে সব কিছু দিয়ে হয়েছে।
ব্রিটিশরা নিজেরাও কম হারামি না, ওই সময়েই চার্চিল আমাদের দেশের তিন লক্ষ লোককে মেরেছিল না খেতে দিয়ে। সেটা যে লিখেছে সেটাই ভালো। নিজেদের দোষ স্বীকার করার মতো সভ্য হয়েছে অন্তত। ইহুদিরা যখন দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছিল, আমেরিকা, ইংল্যান্ড কেউ ওদের জায়গা দেয়নি। তাহলে হয়তো সং্খ্যাটা কিছু কম হত! সেটাও লিখেছে, লুকিয়ে যায়নি।
ওয়ার মিউজিয়ামের বাইরে একটা মস্তো কামান আছে। কোন যুদ্ধে যেন ব্যবহার করা হয়েছিল। তার সামনেই বাগান, সেখানে দেখি একটা গোলাপ ফুটেছে। ঠিক কামানটার সামনেই৷