দোতলা ট্রেন সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্যে৷ মুখোমুখি চারখানা সিট খুঁজে নিয়ে বসি চারজনে। একটু গুছিয়ে বসেই চা পান আর পুর ভরা পাঁউরুটি সেবন। ভিয়েনা থেকে সলজবার্গ হয়ে ইন্সব্রুকে যায় ট্রেনটা। আমাদের গন্তব্য ইন্সব্রুক। সালজবার্গও যাব ফিরতি পথে। তবে কেবল আমি আর ময়ূরাক্ষী। বাকি দুজনের আরাম করে সলজবার্গ ঘোরা। আমাদের মতো হুড়োহুড়ি করে সালজবার্গ কেউই ঘোরে না, সালজবার্গ সেরকম জায়গাই নয়। অন্তত চার-পাঁচদিন থাকো, নদীর ধারে হাঁটো, হাইক করো, হ্রদের পাশে শুয়ে থাকো। যাইহোক, আপাতত ইন্সব্রুকের কথা বলি। সে এক ভারী সুন্দর জায়গা। আল্পসের কোলে, আর এই ভিয়েনা থেকে সালজবার্গ হয়ে ইন্সব্রুকের রাস্তাটাও বড় সুন্দর। মাঝে কিছুটা সময় ট্রেনটা জার্মানি দিয়েও যাবে। মাইলের পর মাইল ফসলের ক্ষেত, সুন্দর সুন্দর বাড়ি। ক্রমে দিগন্তব্যাপী ফসলের ক্ষেতের বদলে পাহাড় দেখা গেল, পাহাড়ের কোলেই ক্ষেত। সালজ নদী পেরিয়ে গেলাম। ট্রেন অনেকটাই খালি এখন। ইস্ট ইওরোপ অনেকটাই চলে বিশ্বাসের উপর। মানুষ ইচ্ছে করে অসততা করবে এ বোধহয় এরা ভাবে না। তাই, ট্রামে বাসে কোথাও টিকিট চেকার থাকে না। একমাত্র মেট্রোয় মাঝে মাঝে চেকিং হয় আর হয় এইসব দূরপাল্লার ট্রেনে। একজন মহিলা চেকার অনেক্ষন আগেই আমাদের টিকিট দেখে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে স্টেশনে থামলে একেকবার এসে দেখে যাচ্ছেন, নতুন কেউ এলো কিনা।
স্টেশনে নেমে, একটা ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার দেখছিলাম। এটা প্রাইভেট ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার। তেমন ভালো না। বলে ইন্সব্রুক কার্ড নিলে এখন থেকেই শুরু হবে। এরকম হয় না। এখানে প্রতিটা শহরের এরকম কার্ড পাওয়া যায়। তাতে করে সুবিধে হয়, দর্শনীয় স্থান বেশীর ভাগ এই কার্ডেই দেখা হয়ে যায়। শহরের মধ্যে বাস ট্রামও এই কার্ড দিয়েই হয়ে যায়। পরে দেখা যাবে খন ভেবে রওনা দিলাম৷ একটা বিএনবি বুক করা আছে আমাদের। স্টেশন থেকে বিএনবি যাওয়ার রাস্তায় একটা নদী পরে৷ ইনস নদী না, ওরই কোনো শাখা হবে। তার পাশ দিয়ে দিয়ে রাস্তা। একটা পার্ক। সেই পার্কে বিস্তর শরীর চর্চা করার জিনিস আছে। এদেশে সুস্থ থাকতে গেলে কসরত করার দরকার পরে না খুব। শরীর চর্চা করার অফুরন্ত জায়গা,পছন্দ না হলে সাইকেল চালাও, দৌড়ও, হাঁটো। গরমের সময়ে ঘরে কেউ বসে থাকেও না। চারিদিকে দৌড়বীর, সাইক্লিস্ট এর পাশ দিয়ে দিয়ে চললাম। এই বিএনবিটার ঢোকার পদ্ধতি হল, লিফটের একটা কোড দিলে লিফট খুলবে, তারপর তোমার ফ্লোর দাও। ঘরে ঢোকার আর একটা কোড! রান্নাঘরে ঢুকতে গ্রিলড মাছের গন্ধে চনমন করে উঠলো প্রাণ। দুজন তরুণ তুর্কী মস্ত একটা মাছ গ্রিল করে 'মৎস্য মারিব খাইব সুখে' ভঙ্গীতে বসেছে। আমরা রেডি টু ইট খাবার কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিকেন বাটার মশালা আর ভাত। কিন্তু তাজা মাছ ভাজার গন্ধের কাছে সে আর কি আর মন মানে৷ খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা বেরোলাম ইন্সব্রুক টহল দিতে। প্রথমেই যাব ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার। ইন্সব্রুক কার্ড কিনে নেব। কাল সারাদিন ঘুরব ইন্সব্রুক চারজন।পরশু সক্কাল সক্কাল ট্রেন ধরে আমি আর ময়ূরাক্ষী যাব সলজবার্গ। সুদীপ মৌসুমী আরেকটু ঘুরবে ইন্সব্রুকে। রাতে একই ট্রেনে ফিরব ভিয়েনা। এখানের ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার গুলো ভারী ভালো হয়। আমাদের যত বক্তব্য শান্ত হয়ে শুনে, সব বুঝিয়ে দিল চমৎকার। টাকা পয়সা মিটিয়ে চললাম নদীর দিকে। রাস্তাতেই একটা চমৎকার চার্চ, ভিতরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। খুবই সুন্দর কাজ চারপাশে। আমাদের দেশে যেমন গঙ্গাজল কেনা যায় ওরাও দেখি জর্ডনের জল কেনার জন্যে পোস্টার দিয়েছে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই ব্যপারটা বেশ। বেসিক প্রফিটের জায়গায় বেশ মিলমিশ। নীচে কার যেন একটা সমাধি আছে৷ চার্চ,ক্যাথিড্রাল, চ্যাপেলের কিছু তফাৎ আছে, আমাদের দেশে আমরা সবই চার্চ বলি, সে হিসেবে চার্চই বলছি। তো চার্চে ঢুকলে আমার কেমন ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনা ঘরে মতো লাগে৷ সেইরকমই ভাবগম্ভীর একটা ব্যপার, উঁচু উঁচু সিলিং, লম্বা টানা বেঞ্চ। খানিক বসে থেকে, চললুম নদীর ধারে। নদীটার উলটো পাড়ে, ইন্সব্রুকের আইকনিক ছবির বাড়ি গুলো সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে। তার ওপাশে পাহাড়। নদীর ধার ধরে হেঁটে গেলে ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিটা কী যে চমৎকার কী বলি! কাচের দেওয়াল, বই থেকে চোখ তুললেই নদী পাহাড়। শীতে বরফে সাদা হয়ে যায় চারধার আর গ্রীষ্মে সবুজ। নদীর ধারে পাতা একটা বেঞ্চে বসে, ফ্লাস্ক থেকে বের করে চা খাই, পকেট থেকে বিস্কুট বেরোয়। শহর জুড়ে হেঁটে বেড়াই, কখনো দুটো আইস্ক্রীম কিনে ভাগ করে খাই। খিদে পেলে টার্কিশ দোকানে যাই,কাবাব বক্স নিই, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাগ করে খাই। অনেক অনেক্ষণ পর অন্ধকার নামার মুখে যখন আলো জ্বলে ওঠে চারপাশ, ফেরার সময় হয়ে যায় তবুও দাঁড়িয়ে থাকি ঠায়। অন্ধকার হবার আগে আকাশের রঙটা আশ্চর্য রকম অন্য হয়ে যায়, সে রঙীন লিখে বোঝানো যায় না। দাঁড়িয়ে দেখছি নদীর অন্য পাড়ে একটা দুটো করে আলো জ্বলছে, মুহূর্তটা ধরে রাখতে নিজেদের একটা খারাপ সেল্ফি তুলছি, এমন সময় একজন ভদ্রমহিলা ছবি তুলছিলেন, বললেন তোমাদের একটা ছবি তুলে দিই? দিলেন, তারপর একটু কথাও হল। চীনা অরিজিন, আমেরিকান। এখন অবসর নিয়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান আর ছবি তোলেন। বেশ ফূর্তির জীবন।
ফিরতি পথে একটা রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে আসছি, দেখি নারী পুরুষ মিলে চমৎকার নাচ গান হচ্ছে। চমৎকার সালসা নাচছে। গিন্নি জানেন খানিক নাচ, আমার নাচ মানে ভাসান ডান্স। বাকি দুই মক্কেল জানেননা বলেই দাবী করেন, তবে ছুপা রুস্তম আছেন। দূর থেকেই তাই দাঁড়িয়ে দেখা হল। এত এনার্জেটিক, এত প্রানোচ্ছল বড় ভালো লাগছিল। আমরা ক্লান্ত, আমাদের গিয়ে খিচুড়ি রাঁধতে হবে, আমাদের কাল সকালে উঠে বেরোতে হিবে এসব ভুলে গিয়েই হাঁ করে তাকিয়েছিলাম অনেক্ষণ। খিচুড়ি তো বানানো হবে, ব্যাগে করে চাল ডাল আলু ফুলকপি সব এসেছিল, কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে? এক রাউন্ড চা হয়ে যাক নাকি? খিচুড়ি ডিমসেদ্ধ বসিয়ে, চা, মুড়ি সমেত বসা গেল রান্নাঘরে। সুদীপের গান শোনা পেন্ডিং আছে বহুদিন, অন্য সময় কান কট কট করছে, পা ব্যথা এসব বলে কাটায়, দুই জন মহিলার সঙ্গে পেরে ওঠেনি সেদিন। সুদীপ দিয়ে শুরু হল, তারপর অন্তাক্ষরীতে চলে গেলাম। সেদিন মজলিশ যা জমেছিল না! আরো বহুক্ষণ চলতে পারতো, তবে খিচুড়ির গন্ধে ফের খিদে চনমন করে ওঠায় থামতেই হল বেয়াক্কেলের মতো।
ইন্সব্রুক টপে নাকি পেল্লায় ঠান্ডা। আল্পসে উঠছি বলে কথা, ইন্সব্রুকের জন্য গাদাগাদা সোয়েটার নিয়ে গেছিলাম। ইন্সব্রুকে বেশ গরম। টিশার্ট পরে ঘোরার বদলে শার্ট আর ব্যাগে সোয়েটার নিয়ে বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে আমরা ইন্সব্রুক ঘুরেছি।খানিক হাবা মতো আছি বটে। সকাল সকাল চা ম্যাগি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ইওরোপে(ইউএসেও) সকাল তাড়াতাড়িই হয়। লোকজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে, কফি, পাঁউরুটি কিনে অফিস যায় সকাল সকাল। আমাদের মতো রাত দশটা অব্দি কল করতে হয় না, তাই তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। আমরাও আমাদের সারাদিনের খাবার মতো স্টাফড পাঁউরুটি, কলা, জুস, সিডার এসব তুলে নিলাম। ইন্সব্রুকের পাহাড়চূড়ায় পৌঁছতে গেলে একটা ট্রেন নিতে হয়। ইন্সব্রুক কার্ডেই ইনক্লুডেড সব, তাই আলাদা টিকিট কাটার প্রয়োজন নেই। ট্রেন মানে আমাদের মতো অনেক কামরা ওয়ালা ট্রেন না, ট্রামের মতো তিনটে কামরা আছে, খাড়াই উঠতে পারে। বসার জায়গা অল্প।দাঁড়িয়ে যেতেই ভালো লাগে বেশী। ট্রাম বলাই ভালো হবে দেখছি একে৷ ট্রামে করে পাহাড়ের মাঝের একটা জায়গায় নামা হল। এর পরে আর ট্রাম চড়বে না। কেবল কার, মানে ওই বন্ধ রোপওয়ে আর কি। যে জায়গায় নামলাম সেখান থেকে পুরো ইন্সব্রুক শহরটা দেখা যায়। দূরবীনে চোখ রেখে চেনা যায় শহরের বিখ্যাত জায়গা গুলো। পাহাড় এখন হাতের নাগালে প্রায়। বসে বসে ছবি তুললে মনে হবে কাকা পাহাড়ের কোলে চড়েছি, আর খোকার ছবি তুলেছে কেউ। বরফ গলে গেছে বেশীরভাগ, অল্প আধটু আছে, উপর থেকে নীচে তাকালে সবুজে সবুজ আর উপর দিকটা রুক্ষ।
কেবল কারে বেজায় ভীড়। তারমধ্যেই কাচের দেওয়াল দিয়ে দেখি নীচে তাকিয়ে কয়েকজন পাগল সাইকেলে করে পাহাড় বাইছে, স্ফূর্তির অভাব কিছু আছে বলে মনে হয়না এই পরিশ্রমেও। অনেকে হাইক করছে। কেউ কেউ নীচে গাছের নীচে বসে বসে বই পড়ছে বা খাওয়া দাওয়া। উজ্জ্বল দিন। রোপওয়ে পৌঁছে দেবার পর, অল্প পাহাড় বাইতে হয় একদম চুড়োটায় উঠতে গেলে। এখান থেকে কয়েকজন প্যারাগ্লাইডিং করার চেষ্টায় আছে। পাহাড়ের খাঁজে বসে সবে আমাদের খাবারের ঝোলা হাতড়ে বের করেছি জিনিস্পত্র, বেশ কটা সাহসী পাখি এসে হাজির। পারলে গায়ে মাথায় উঠে বসে।
উপর থেকে নেমে আসার পথে একটা চিড়িয়াখানা পড়ে। অ্যালপাইন জু। আমাদের টায়ার্ডনেসের জন্যে হোক, ম্যাপ বুঝতে না পারার জন্যে হোক অত ভালো কিছু দেখা গেল না, কিছু দেখা হল। এরা ব্যাটারা ভেড়া, গরু, রামছাগল সব রেখেছে চিড়িয়াখানায়। গন্ধে আকুল হয়ে যাবে ওই জায়গাটা পেরোতে। তাও ম্যাডাম গরু বলে কথা, তামাম ভারতবর্ষের মসীহা হয়ে খড় চিবুচ্ছে, তার দর্শন তো করতেই হয়! একটা গাছের পাশে একটা কবর, জন্তু জানোয়ার কছু নেই বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু জায়গাটা বড় ভালো। বড় বড় গাছের ছায়া, লোকজন নেই। আমাদের লাঞ্চের আদর্শ জায়গা বলা যায়। পানাহার এর পর্ব শেষ করে বোঁচকা বেঁধে ফেরার ট্রেন ধরতে প্ল্যাটফর্মে এলাম। এদের দেশে লোক কম, তাই হয়তো জীবনের দাম বেশী। প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনের মধ্যেকার ফাঁকটা ট্রেন এসে দাঁড়ালে স্বয়ংক্রিয় ভাবে একটা লোহার পাটাতন এসে ঢেকে যায়৷ দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আবার সে নিজে থেকে গুটিয়ে যায়৷ শহরে এসে আমরা খানিক এদিক সেদিক ঘুরলাম।প্রথমে অ্যামব্রেস কাসলে একটা ঢুঁ মারা হল। শহর থেকে একটু তফাতে এই কাসলটা। কম কম বাস যায়। স্টপেজ এলে আমাদের ট্যুরিস্ট বুঝে যাত্রীরাই ইঙ্গিত করে নামিয়ে দিল। হরেক রকম মস্ত মস্ত গাছ, পুকুর, মাঠ দিয়ে ঘেরা বেশ কাসল। বেজায় রোদ বলে একট বেঞ্চে জিরিয়ে নিচ্ছি, ঝিম ধরে আসে প্রায়, এমন সময় ক্যাঁ ক্যঁ করে কর্কশ ডাকে তাকিয়ে দেখি এক জোড়া ময়ূর। এ তাদেরই বাড়ি, সুতরাং ভয়ডর নেই। খুঁটে খুঁটে পোকা টোকা খাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। এমন চমৎকার দেখতে একটা প্রাণীর এমন কর্কশ ডাক ভাবা যায় না! অবশ্য না যাবারও কিছু নেই। যা বাইরে সুন্দর তাইই অন্তরে সুন্দর হলে আর এত যুদ্ধ হয় চারপাশে! অনেকদিন আগে সম্ভবতঃ অটোমান রাজত্বের সময়, এক সৈনিক ছিল, নাম গ্রেগর বাচি, সে তার ডান চোখে বর্শার আঘাত পেয়েছিল। বা বলা ভালো তার ডানচোখ হয়ে খুলি ফুঁড়ে একট বর্শা ঢুকে গিয়েছিল এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তারপরেও সে বেঁচে গিয়েছিল। একটা স্কাল্পচার বানানো আছে তার খুলি আর ওই বর্শার টুকরোর কাসলের ভিতরে। আরো হরেক জিনিস আছে এক্সোটিক বলে অংশটায়। তার মধ্যে হাতির দাঁতের অতি সুক্ষ সব কাজ, ড্রাকুলা নামে খ্যাত তৃতীয় ভ্লাদের ছবি ইত্যাদি। একটা ছবি বেশ অবাক করায়, কিংবা অবাক না হবারই কথা, রাজাকে উপহার দেওয়া হয়েছে একজন বিকলাঙ্গ মানুষ। এক্সটিক বটে! বর্ম, অস্ত্রের যেমন সম্ভার থাকে তা তো আছেই, তার মধ্যে এক প্রকার বর্ম অবাক দেখে আমি তো যাকে বলে এক গাল মাছি! হাত পা বুক মাথা নাক সব সুরক্ষিত, এদিকে আসল দুর্বল জায়গাটিই ফাঁকা! তাই বলি গালিয়থ কী করে ডেভিডের একটা গুলতির আঘাতেই ঘায়েল, টাকে উঠে যাওয়া ব্যপার!
ওখান থেকে একটা লেকের ধারে যাওয়া হল। সেও শহর থেকে খানিক দূরে। লেকের পাশে এক আইস্ক্রীমের দোকানে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। এখানে ছেলে বুড়ো সব্বাই আইস্ক্রীম খেতে বেজায় ভালোবাসে। আর খেতেও হয় চমৎকার। হরেকরকমেকরকম ফ্লেভার, তার থেকে একটা পছন্দ করো। আমরাও করলাম। আইস্ক্রীম খেয়ে লেকের ধারে বসে, শুয়ে রইলাম বহুক্ষণ। মাঝে মুড়ি খাওয়া হল, কলা খাওয়া হল। লেকের নীচটা পাথুরে মতো, জলে নামতে গেলে পায়ে বেধে। তাতে কি কারোর ভ্রুক্ষেপ আছে! সব ছেলে মেয়ে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে ঝপাং! কেউ শুয়ে রোদে ট্যান হচ্ছে, কেউ বই পড়ছে। গ্রীষ্মকাল যে হাজির তা বোঝা যায় বটে। দুটো জিনিস চোখে পড়ে, আব্রু নিয়ে এদের এত মাতামাতি নেই, বহু ছেলে-মেয়েই সামান্য আড়ালে গিয়ে বা না গিয়ে ভিজে পোশাক বদলে নিচ্ছে। আমাদের গঙ্গার ঘাটে যেমন করে চান করে উঠে, প্রায় তেমনই। কেউ তাকিয়ে দেখছেও না। আর পাবলিক টয়লেট গুলোও অতি পরিষ্কার। সন্ধ্যে নামার মুখে ফেরার পথ ধরলাম।
ইন্স নদীর ধারে ফিরে ইতস্তত: ঘুরছি।একটা ভারতীয় দল ট্যুর এজেন্সির সাথে এসেছে দেখছি, ওই হয় না এজেন্সি গুলোর "লেজার টাইম", সেরকম কিছু হবে, দলের বেশীরভাগ লোক লোকজন পার্কে বসে জিরুচ্ছে। হাঁটার অভ্যেস না থাকলে বিদেশে অসুবিধে আছে ঘোরার এ কথা সত্যি। হ্যাঁ, বাস-ট্রাম সবই খুব আছে, কিন্তু ঘুরতে গেলে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই কিন্তু। তাছাড়া বাস ট্রাম সর্বদা নির্দিষ্ট জায়গায় থামে, সারা রাস্তাটাউ আমার স্টপ না কিংবা নির্দিষ্ট জায়গাতেই খাবার পাওয়া যায়, সারা রাস্তাটাই আমার রেস্তোরাঁ না। ঘুরতে ঘুরতে শেষ বিকেলে একটা গীর্জায় ঢুকেছি, সে সময় তাদের প্রার্থনা চলছিল। কল্পনা করতে আমি ভালোবাসি। কত সময় তুচ্ছ তালা চাবি নিজেদের মধ্যে কী কথা বলতে পারে জাতীয় কল্পনা কিংবা পিঁপড়েদের মানুষ সম্পর্কে ধারণা আমি কল্পনা করে থাকি। কিন্তু কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে চাট্টি ফলমূল কিংবা নকুলদানা কিংবা পাঁউরুটি কিংবা খেজুরের লোভে পাঁচটা বাজে আবদার কি কান্নাকাটি সইবে এটা আমার মতো কল্পপ্রাণ লোকও ভাবতে পারে না। তবে তা আমি মন্দির মসজিদ গীর্জা গুরুদ্বোয়ারা কোত্থাও প্রকাশ করিনা। পেটের কথা চেপে রাখলে যদি মিষ্টি টিষ্টি পাওয়া যায় মন্দ কি! তাছাড়া সত্যি বলতে নির্জন চার্চে, মন্দিরে, মসজিদে বসে থাকতে আমার ভালোই লাগে, বিশেষ করে গ্রীষ্মের দিনে। আর ভালো লাগে, গান। ভগবানের উদ্দেশ্যে হওয়া বেশীর ভাগ গানের সুরই আমার বেশ লাগে। তো যে গীর্জায় যখন গেছি, তাদের প্রার্থণা চলছে। অনেকে মিলে বসে, গীটারে গান ধরেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম অনেক্ষণ। তারপর বেরিয়ে নদীর ধারে। ইন্সব্রুকে এই আমাদের শেষ রাত। যতক্ষণ পারি চেটে পুটে নিই।
No comments:
Post a Comment